গ্রামীন ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা
গ্রামীণ বাংলাদেশ প্রাণবন্ত ক্রীড়া ও ঐতিহ্যের ভান্ডার, যা দেশের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে প্রতিফলিত করেছে। ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা থেকে শুরু করে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলে আসা বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক উৎসব যা দেশের বিভিন্ন সম্প্রদায়কে একত্রিত করেছে, এই গ্রামীণ ঐতিহ্যমন্ডিত সাংস্কৃতিক চর্চা গুলি বাংলাদেশের পরিচয় ও সামাজিক কাঠামো গঠনে গুরুত্ব ভূমিকা পালন করছে। এই প্রবন্ধে আমরা বাংলাদেশের গ্রামীণ খেলাধুলা ও ঐতিহ্যের বৈচিত্র্যময় বিন্যাস অনুসন্ধান করার চেষ্টা করব এবং এগুলোর ঐতিহাসিক শিকড়, সাংস্কৃতিক তাৎপর্য এবং আধুনিক যুগে এগুলো যে চ্যালেঞ্জ গুলোর মুখোমুখি হয় তা অনুসন্ধান করার চেষ্টা করব। উপরন্ত আমরা দেশের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের উন্নয়নে এই ঐতিহ্যের চর্চা গুলোর ভূমিকা, দেশের উন্নয়নে এদের প্রভাব এবং এগুলো সংরক্ষণ ও প্রচারের জন্য প্রয়োজনীয় প্রচেষ্টা গুলো জানার চেষ্টা করব। আশা করছি আপনারা বাংলাদেশের গ্রামীণ খেলাধুলা ও মনোমুগ্ধকর বিশ্ব ঐতিহ্য আবিষ্কার করতে আমাদের সাথে থাকবেন।
গ্রামীণ ক্রীড়া ও ঐতিহ্যের পরিচিতি
বাংলাদেশের খেলাধুলা ও ঐতিহ্যের কথা বললে বলতে হয়- “ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে কিভাবে টিকিয়ে রাখতে হয় সেই বিষয়টি বাংলাদেশ খুব ভালোভাবে জানে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অবস্থিত বাংলাদেশ এর মধ্যে আপনি পেয়ে যাবেন সাংস্কৃতিক চর্চার একটি সমৃদ্ধ মেলবন্ধন যা প্রজন্মের মধ্য দিয়ে বহুকাল ধরে চলে আসছে। এই খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য শুধুমাত্র সাংস্কৃতিক চর্চার তাৎপর্যই রাখে না, বরং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি আভাসও প্রদান করে।
সাংস্কৃতিক তাৎপর্য
গ্রামীণ বাংলাদেশে খেলাধুলা ও ঐতিহ্য নিছক সময় কাটানোর কার্যকলাপ নয় বরং সাম্প্রদায়িক সামাজিক কাঠামোর মধ্যে গভীরভাবে মেলবন্ধন রচনা করার একটি মাধ্যম বটে। দেশের এই সংস্কৃতি গুলি আপামর সর্বসাধারণকে একত্রিত করতে এবং ঐক্যের বোধ জাগিয়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এগুলো দেশের প্রতিটি অঞ্চলের অনন্য সাংস্কৃতিক পরিচয় প্রদান করে এবং সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
গ্রামীণ ক্রীড়া ও ঐতিহ্যের ঐতিহাসিক শিকড়
এদেশের এই গ্রামীন খেলাধুলা ও ঐতিহ্যের উৎপত্তি বহু শতাব্দি আগে থেকে পাওয়া যায়। বাংলাদেশের বিভিন্ন ঐতিহাসিক যুগে প্রচলিত প্রাচীন রীতিনীতি ও আচার অনুষ্ঠান দ্বারা অনেক প্রথিতযশা সাংস্কৃতিক কর্মী বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছেন। তারা এদেশের সমৃদ্ধ ইতিহাসের একটি প্রমাণ হিসেবে কাজ করছেন এবং জনগণের স্থিতিস্থাপকতা ও সৃজনশীলতার গবেষক হিসেবে কাজ করছেন।
বাংলাদেশের গ্রামীণ খেলাধুলা ও ঐতিহ্য
বর্তমানে যদিও ক্রিকেট মূল ধারার খেলাধুলায় সর্বোচ্চ রাজত্ব করছে, তথাপি বাংলাদেশের গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা গুলো নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে ও স্বকীয়তায় রয়েছে যা সময়ের পরীক্ষায় দাঁড়িয়েছে বলে অনেক সাংস্কৃতি কর্মী মনে করেন। চলুন জেনে নেই দেশের ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ খেলাধুলা সম্পর্কে কিছু কথা-
কাবাডি বা হা ডু ডু
বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী খেলা হলো "কাবাডি'- যাকে বলা হয় জনতার খেলা। এই খেলা ভারতবর্ষে উৎপত্তি ও বিবর্তন লাভ করে। আধুনিক সময়ে কাবাডি অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি খেলা এবং এর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি রয়েছে। এই খেলা অনেক শক্তি কৌশল এবং বুদ্ধিমত্তার প্রতিফলনের সমন্বয়ে খেলা হয়। এই খেলায় দুটি দলে বিভক্ত হয়ে খেলা হয়। একটি দম নিয়ে বা যতটা সম্ভব শ্বাস বন্ধ করে প্রতিপক্ষের অঞ্চলে একটি রাইডার পাঠানো হয় এবং তিনি প্রতিপক্ষের যে কাউকে ছোঁয়ার চেষ্টা করেন। একটি দমে প্রতিপক্ষের কাউকে ছুয়ে নিজের অঞ্চলে বা ঘরে ফিরে আসতে পারলে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড় মারা পড়েন এবং নিজেদের পয়েন্ট বৃদ্ধি পায়। অনুরূপভাবে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়েরা রাইডারকে ধরে নিজেদের অঞ্চলে বা ঘরে রাখার চেষ্টা করেন এবং যখন রাইডার তার নিজের দলে ফিরে যেতে সক্ষম না হোন তখন তিনি মারা পড়েন। মূলত এভাবেই খেলা এগিয়ে চলে।
একটি খেলায় দুটি দল জড়িত প্রত্যেক প্রতিপক্ষের অঞ্চলে একটি রাইডার পাঠানো হয় পালা করে, একটি দম বা শ্বাস না নিয়ে যতটা সম্ভব এর প্রতিপক্ষদেরকে ছোঁয়ার চেষ্টা করে। এই খেলাটি অত্যন্ত দ্রুতগতির এবং আনন্দদায়ক যা নিজের শরীরের অ্যাড্রেনালিন পাম্পিং কার্যক্রম চলমান রাখতে এবং দর্শকদের আনন্দে মাতিয়ে রাখতে পারে।
ষাঁড়ের লড়াই
ষাঁড়ের লড়াই মূলত স্পেন দেশীয় সংস্কৃতির একটি অংশ হলেও, বাংলাদেশে এই খেলার সূত্রপাত বহু কাল পূর্ব থেকেই। বছরের একটি নির্দিষ্ট দিনে ষাঁড়ের মালিকেরা একটি নির্দিষ্ট জায়গায় জমা হন এবং একটি ষাঁড়ের সাথে আর একটি ষাঁড়ের লড়াই শুরু করান। যে ষাঁড়টি বিজয়ী হবে তার মালিক হবেন ষাঁড়ের লড়াই খেলার বিজিত ব্যক্তি এবং তাকে পুরস্কৃত করা হয়।
ঘোড়া দৌড়
ষাঁড়ের লড়াইয়ের মতোই ঘোড়া দৌড় খেলাটি অত্যন্ত প্রাচীন একটি খেলা। এই খেলায় একসাথে অনেকগুলো ঘোড়া দৌড় এর প্রতিযোগিতা করে। ঘোড়ার মালিকেরা নিজেরা শাওয়ার হয়ে এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। এই দৌড় প্রতিযোগিতায় ঘোড়া দৌড়ের নির্ধারিত স্থানে যিনি প্রথম পৌঁছাতে পারবেন তিনিই হবেন বিজিত ব্যক্তি।
পুতুল খেলা
অন্যান্য খেলার মত পুতুল খেলাও বাংলাদেশের বেশ জনপ্রিয় একটি খেলা। এই খেলা ছোট বাচ্চারা সবচেয়ে বেশি অংশগ্রহণ করে থাকে। ছোট ছোট পুতুল সংগ্রহ করে সেই সমস্ত পুতুলগুলোকে সাজিয়ে একটি সংসার সাজানোর মতো করে এই খেলাটি খেলা হয়। এই খেলায় পুতুলদের বর ও বউ সাজিয়ে বিয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে যাবতীয় কর্মকাণ্ড বিশেষ করে একটি সংসার যেভাবে পরিচালনা করা হয় সেই ভাবে খেলা হয়ে থাকে।
দাড়িয়া বান্ধা
বাংলাদেশে অনেকগুলো জনপ্রিয় খেলা গুলোর মধ্যে দাড়িয়া বান্ধা একটি অন্যতম খেলা। এই খেলা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন নামে পরিচিত। কেউ কেউ এই খেলাকে বদন খেলা, আবার কেউ কেউ গাদন খেলা বলে থাকেন। শিশু কিশোরী থেকে শুরু করে নারী পুরুষ নির্বিশেষে এই খেলা খুব সহজেই খেলা যায়। ৯০ এর দশকে এই খেলার প্রচলন অত্যন্ত বেশি থাকলেও বর্তমানে এই খেলার অস্তিত্ব বিলীন হতে চলেছে। অন্যসব খেলার মত এই খেলা দুটি দলে বিভক্ত হয়ে খেলা হয়। কিশোর কিশোরীদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য এই খেলাটি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে স্বাস্থ্য বিশারদগণ মনে করেন।
এছাড়া বর্তমান যুগে শিশু কিশোরদের মোবাইল ফোন আসক্তি ও তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে দূরে রাখতে এই খেলাকে মাধ্যম হিসেবে বেছে নেওয়া যেতে পারে। এই খেলা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন নিয়মে পরিচালিত হয়, তবে বর্তমানে এদেশে এই খেলার সুষ্ঠু মীমাংসা ও পরিচালনার জন্য গ্রহণযোগ্য নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে।
গ্রামীন বাংলার আরো কিছু খেলাধুলা
বাংলাদেশে গ্রামীণ খেলাধুলা গুলোর মধ্যে কিছু কিছু খেলা আছে যা শুধু মেয়েরাই খেলে থাকে। মেয়েদের সবচেয়ে প্রিয় দুটি খেলার মধ্যে টোপাভাতি খেলা ও পুতুল খেলা অত্যন্ত জনপ্রিয়। টোপা ভাতি হলো বনভোজনের আদলে একটি খেলা, যেখানে মেয়েরা ব্যাতিক্রমী রান্নাবান্না খেলা খেলে থাকে। আর পুতুল খেলা সচরাচর ছোট বাচ্চারা পুতুল বিয়ে দেওয়া সংক্রান্ত খেলা খেলে থাকে। এছাড়া মেয়েদের খেলাধুলার মধ্যে রয়েছে বউ চি, ঘুটি খেলা, এলাটিং বেলাটিং, কড়ি খেলা, ওপেন টি বায়োস্কোপ ইত্যাদি। মেয়েরা বর্তমানে ফুটবল ও ক্রিকেটে অংশগ্রহণ করলেও তা সংখ্যায় অতি নগণ্য। এ কারণেই হয়তো মেয়েদের খেলা গুলো এখনো টিকে আছে।
বাংলাদেশের গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলার মধ্যে বউচি, কানামাছি ভোঁ ভোঁ, গোল্লাছুট, ডাংগুলি নৌকা বাইচ, লাঠিখেলা, বলী খেলা, চোর ডাকাত, মার্বেল, ষাঁড়ের লড়াই, মোরগ লড়াই, জব্বারের বলি খেলা, লাটিম খেলা, ষোল গুটি ইত্যাদি।
এছাড়া গ্রাম বাংলার মধ্যে আরও যে সমস্ত খেলা গুলো প্রচলিত ছিল সেগুলোর মধ্যে রুমাল চুরি, আগডুম বাগডুম, ইকড়ি মিকড়ি, ঝুম ঝুমা ঝুম, নোনতা বল রে, কপাল টোকা, বৌরানী, ছক্কা, চিলমোরগ, বুঝাবুঝি, ষোলগুড্ডা, কুতকুত, বাঘ ছাগোল খেলা, মন্দুরুজ্জু, বোম বাস্টিং, দড়ি টানা, চেয়ার সিটিং, ফুলটোকা, গোস্ত তোলা, অ্যাঙ্গো অ্যাঙ্গো, ল্যাংচা, হাড়িভাঙ্গা, কাঠি ছোঁয়া, দড়ি লাফানো, বরফ পানি, গরম বালিশ, বস্তা দৌড়, সুঁচে সুতা পড়ানো, বিস্কিট দৌড়, তিন পায়ে দৌড়, অংক খেলা, মেধা যাচাই খেলা, সাপলুডু খেলা, দাবা খেলা, কিৎ কিৎ খেলা, মইলা, সাতচাড়া, রাম সাম যদু মদু, ডালিম খেলা, পানি ঝুপ্পা, গোলাপ টগর, গাই গোদানি ইত্যাদি অন্যতম।
উপসংহার
বাংলাদেশের গ্রামীণ খেলাধুলা ও এর ঐতিহ্যগুলো এদেশের জন্য একটি অমূল্য সাংস্কৃতিক সম্পদ। এই সম্পদকে রক্ষা করা হলে এগুলো শুধু এদেশের মানুষের জন্য বিনোদন এবং আনন্দ প্রদান করবে না বরং দেশের সাংস্কৃতিক পরিচয় কে অত্যন্ত শক্তিশালী ও সুগঠিত করবে এবং সামাজিক সংহতি প্রতিষ্ঠিত হবে। গ্রামীণ এইসব খেলা গুলো নতুন প্রজন্মের কাছে নিছক গল্পের মত মনে হয় আবার অনেকেই এইসব খেলার কথা শুনে হাসাহাসি করেন। আমাদের আদি এই সাংস্কৃতিক সম্পদকে রক্ষা করার জন্য অবশ্যই দেশের সরকারকে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া দেশের সংস্কৃতিকে রক্ষার জন্য গ্রামীণ পর্যায়ে ক্রীড়া ফেডারেশন গঠন করা হলে এই সকল ঐতিহ্যবাহী খেলা গুলোকে সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে বলে অনেকেই মনে করেন।