ভূমিকা
বর্তমান ডিজিটাল যুগে মোবাইল ফোনের ব্যবহার দিনকে দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠছে। প্রিয়জনদের সাথে যোগাযোগ করা থেকে শুরু করে যে কোন তথ্যের আদান-প্রদান, এমনকি আর্থিক লেনদেন এর মত সুবিধা মোবাইল ফোন এর মাধ্যমে পাওয়া যায়। যাই হোক, এই সকল সুযোগ-সুবিধা থাকার পরেও আমরা অনেকেই মোবাইল ফোন কিভাবে ব্যবহার করতে হবে সেটি হয়তো জানি না। আর এই না জানার কারণে, আমরা আমাদের মনের অজান্তেই আমাদের নিজেদের ক্ষতি সাধন করছি। কিন্তু কিভাবে ক্ষতি করছি? আজকে এই আর্টিকেলে আমরা সেটি আলোচনা করার চেষ্টা করব। আমরা এই আর্টিকেল এ মোবাইল ফোনের ব্যবহার ও এর ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে আলোচনা করব। এই আলোচনায় মোবাইল ফোন কিভাবে আমাদের ক্ষতি করছে, ঘুমানোর সময় মোবাইল ফোন কোথায় রাখব, কত দূরে রাখবো এবং স্মার্টফোনের যে ক্ষতিকর প্রভাব সেই বিষয়ে জানার চেষ্টা করব।
অতিরিক্ত মোবাইল ফোন ব্যবহারের কারণে যে সকল সমস্যা আমাদের শরীরের মধ্যে দেখা যেতে পারে, সেগুলোর মধ্য চোখের দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া, কানে কম শোনা, পুরুষদের শুক্রাণু কমে যাওয়া, শরীরের অস্থি সন্ধিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া এবং মানসিক রোগ নোমোকফিয়ার মত রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি দেখা যায়।
দৃষ্টিশক্তির হ্রাস
সাধারণত সংবাদপত্র, বই কিংবা অন্য কোন কিছু পড়ার সময় চোখ থেকে গড়ে ৪০ সেন্টিমিটার দূরত্বে থাকা উচিত। কিন্তু যুক্তরাজ্যের চক্ষু বিশেষজ্ঞরা এক গবেষণায় দেখেছেন, স্মার্টফোন ব্যবহারকারীরা সাধারণত চোখ থেকে ৩০ সেন্টিমিটার দূরত্ব রেখে ব্যবহার করেন। আবার অনেকের ক্ষেত্রে এই দূরত্বের মাত্রা ১৮ সেন্টিমিটার এর মধ্যে থাকে। মোবাইল ফোনের এই অতি ও অপব্যবহার দৃষ্টি শক্তির হ্রাস করতে পারে, এতে করে মায়োপিয়া বা ক্ষীণ দৃষ্টি রোগ এর সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। গবেষক দল সে সাথে পরামর্শ দিয়েছেন দীর্ঘক্ষণ ধরে মোবাইল ফোন ব্যবহার না করে দৈনিক কিছু সময় মোবাইল ফোন থেকে দূরে থাকার জন্য।
কানে কম শোনা
আমরা অনেকেই কানে হেডফোন লাগিয়ে উচ্চস্বরে গান শুনি অথবা কথা বলি। অধিক সময় ধরে গান শোনার কারণে আমাদের কানের মধ্যে অন্তঃকর্ণের কোষগুলোর উপর প্রচন্ড চাপ পড়ে এবং মস্তিষ্ক অস্বাভাবিক আচরণ করে। মোবাইল ফোনের অতিরিক্ত এই অপব্যবহারের ফলে বধির হয়ে যাওয়ার মত সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।
স্লিপ ডিজঅর্ডার ও শুক্রাণু কমে যাওয়া
কম্পিউটার, মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, ট্যাবলেট ইত্যাদি প্রতিদিন অতিরিক্ত ব্যবহার ও দেখার ফলে ঘুমের সমস্যা ও বা নিদ্রাহীনতা সমস্যা দেখা যেতে পারে। গবেষকদের দাবি, এই সকল ডিভাইস গুলো যারা অতিমাত্রায় ব্যবহার করেন, তাদের শরীরে মেলাটোনিন এর ঘাটতি দেখা দিতে পারে। এর কারণ হলো- এই সকল প্রযুক্তি পণ্য থেকে নির্গত উজ্জ্বল নীল আলোক রশ্মি।
মোবাইল ফোন থেকে হাই ফ্রিকুয়েন্সির ইলেক্ট্রো-ম্যাগ্নেটিক রেডিয়েশন বা উজ্জ্বল আলোক রশ্মি নির্গত হওয়ার কারণে মস্তিষ্ক ও শরীরের অন্যান্য কোষগুলো ক্ষতিকর তরঙ্গের প্রভাবে ক্ষতির মুখে পড়তে পারেন। এছাড়া এই উজ্জ্বল আলোক রশ্মি পুরুষদের প্রজননতন্ত্রের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। তাই গবেষকরা দাবি করছেন, অতিরিক্ত মোবাইল ফোন ব্যবহার করলে মোবাইল থেকে নির্গত উজ্জ্বল আলোক রশ্মি পুরুষদের শুক্রাণুর উপর প্রভাব ফেলতে পারে, এমনকি শুক্রাণুর ঘনত্বকে কমিয়ে দিতে পারে।
শরীরের অস্থি সন্ধিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত
কম্পিউটারে কাজ করা, টিভি দেখা, মোবাইল ফোন চালানো, ল্যাপটপ, ট্যাবলয়েড ইত্যাদি চালানোর সময় অনেকেই অতিরিক্ত ঝুঁকে বসে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করেন বা সময় অপচয় করেন। এতে আপনার শরীরের অস্থিসন্ধি গুলো সহজেই রোগাক্রান্ত হতে পারে, এমনকি আর্থ্রাইটিস এর মত সমস্যা আপনার শরীরে তৈরি হতে পারে। এ কারণেই চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের পরামর্শ হচ্ছে- অতিরিক্ত সময় ধরে মোবাইল ফোনে বার্তা লিখবেন না কিংবা অতিরিক্ত সময় ধরে অকারণে মোবাইল ফোন চালানো থেকে বিরত থাকুন। এতে প্রযুক্তি ডিভাইস থেকে নির্গত উজ্জ্বল আলোক রশ্মি থেকে রেহাই পেতে পারেন।
মোবাইল ফোন রেডিয়েশন কি
বর্তমানে উন্নত তথ্য প্রযুক্তির যুগে মোবাইল ফোন এর ভালো এবং মন্দ দুটি দিক রয়েছে.। বেশি পরিমাণ ভালো গুন থাকার পরেও এই ডিভাইস ব্যবহারে কিছু খারাপ দিক রয়েছে, যা আমরা সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমরা আমাদের নিজেদেরকে স্বাস্থ্য ঝুঁকির দিকে প্রতিনিয়ত ঠেলে দিচ্ছি। সেই ক্ষেত্রে বর্তমান সময়ে সুরক্ষিত ও নিরাপদ থাকার জন্য যে বিষয়টি আমাদেরকে জানতে হবে, সেটি হচ্ছে মোবাইল ফোন এর রেডিয়েশন সম্পর্কে। কি এই মোবাইল ফোন রেডিয়েশন?
যেকোনো ডিভাইসের সাথে অন্য আর একটি ডিভাইস এর সংযোগ স্থাপনের জন্য একটি নেটওয়ার্কের প্রয়োজন হয়। মোবাইল ফোনের ক্ষেত্রেও এই নিয়মের ব্যতিক্রম নয়। একটি মোবাইল ফোনের সাথে আরেকটি মোবাইল ফোন সংযোগ স্থাপন করার জন্য টেলিকম সংস্থাগুলি প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন এলাকায় মোবাইল ফোন টাওয়ার স্থাপন করে। মোবাইল ফোন এবং মোবাইল ফোনের টাওয়ার এই সকল ডিভাইস গুলো শুধুমাত্র সংযোগ স্থাপনের জন্য ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এই সকল ডিভাইস থেকে এক ধরনের বিশেষ বিকিরণ তরঙ্গ (ইলেকট্রম্যাগনেটিক রেডিয়েশন) নির্গত হয়। এই বিশেষ বিকিরণ তরঙ্গই হল মোবাইল ফোন রেডিয়েশন। মোবাইল ফোন, মোবাইল ফোন এর টাওয়ার এই সকল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে যে বিকিরণ তরঙ্গ নির্গত করে সেটিকে দুই ভাবে দেখা হয়। প্রথমটি হলো টাওয়ার রেডিয়েশন এবং দ্বিতীয়টি হল মোবাইল ফোন রেডিয়েশন। টাওয়ারের মাধ্যমে যে রেডিয়েশন নির্গত হয় সেটি আমাদের শরীরের সাথে সরাসরি কোন প্রভাব পড়ে না বলে এর ক্ষতিকর দিক তুলনামূলকভাবে অনেক কম। কিন্তু মোবাইল ফোন এর মাধ্যমে যে রেডিয়েশন নির্গত হয় তা আমাদের শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতি সাধিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। তাই ২৪ ঘন্টা হাতে ফোন থাকলে মোবাইল ফোন রেডিয়েশন এর কারণে স্বাস্থ্যের ব্যাপক ক্ষতিসাধন হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।
মোবাইল ফোনের ব্যবহার যতোটুকু সম্ভব কমানো থেকে শুরু করে আপনি যখন কোন ফোন কিনতে যাবেন, তখন সাধারণত ক্যামেরা কত মেগাপিক্সেলের, ইন্টারনাল মেমরি কত জিবি কিংবা ব্যাটারি ব্যাকআপ কত ঘন্টার- এইসব বিষয়গুলো জানার পাশাপাশি আপনার মোবাইল ফোনের রেডিয়েশন লেভেল কত তা জেনে নিলে সবচেয়ে ভালো হয়। বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন যাবত মোবাইল ফোন থেকে নির্গত রেডিয়েশন বা তেজস্ক্রিয়তা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হতে পারে সম্পর্কে যে হুশিয়ারের কথা বলে আসছেন, সেটিকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে। সুতরাং মোবাইল ফোনের RAM কত কিংবা ডিভাইসটির গুণগত মান ইত্যাদি বিবেচনা করার মতো উক্ত ডিভাইসটির( মোবাইল ফোনের) রেডিয়েশন লেভেল ইত্যাদি বিষয় জেনে নিয়ে আপনার হ্যান্ডসেট টি ক্রয় করা উচিত। মোবাইল ফোনের রেডিয়েশনের মাত্রা পরিমাপ করা হয় SAR ভ্যালু দিয়ে। প্রত্যেকটা মোবাইল অপারেটর সংস্থা ম্যানুয়ালে মোবাইল ফোনের SAR ভ্যালু উল্লেখ করে থাকে। এরপরও আপনি যদি আপনার হ্যান্ডসেটের রেডিয়েশনের মাত্রা জানতে চান তাহলে *#০৭# এ ডায়াল করলে আপনার মোবাইলের স্ক্রিনে রেডিয়েশনের মাত্রা সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য পেয়ে যাবেন।
শেষ কথা
মনে রাখবেন, আপনার সুস্বাস্থ্যের জন্য ঘুম অত্যন্ত মূল্যবান। তাই একটি মোবাইল ফোন এর কারণে আপনার স্বাস্থ্য হানি হোক এটা আপনি নিশ্চয়ই চাইবেন না। মোবাইল ফোন মুক্ত ঘুমের পরিবেশ তৈরি করা এবং আপনার স্বাস্থ্যকে নিরাপদ রাখা আপনার জন্য হিতকর হতে পারে। আপনার হাতে থাকা ক্রয় করা মোবাইল ফোনটি কতটুকু বিকিরণ ছড়াচ্ছে তা ফোনের সাথে থাকা ম্যানুয়ালটি পড়ে নিতে পারেন। আলোচনার শেষে, আমরা এই কথা বলতেই পারি, মোবাইল ফোন নিয়ে ঘুমানোর সম্ভাব্য ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাওয়া এবং এর ক্ষতিকর প্রভাবকে উপেক্ষা করা আমাদের মোটেই কাম্য নয়। সুতরাং মোবাইল ফোন মুক্ত একটি ঘুমের পরিবেশ তৈরি করা এবং আপনার জন্য একটি স্বাস্থ্যকর রুটিন তৈরি করা আপনার জন্য একটি আবশ্যকীয় বিষয় হতে পারে।
স্বচরাচর জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন
ঘুমের সময় মোবাইল ফোন থেকে কত দূরে থাকা নিরাপদ?
ঘুমের সময় আপনার শরীর থেকে মোবাইল ফোন কত দূরে রাখবেন, এইটা সাধারণত এখন পর্যন্ত ধরা বাধা নিয়ম পাওয়া যায়নি। তবে বিশেষজ্ঞরা যেটি বলছেন, সেটি হচ্ছে আপনার শরীর থেকে কমপক্ষে ৩ ফুট দুরত্বে ঘুমের সময় আপনার ফোন রাখা উচিত। কারণ ক্রমবর্ধমান দূরত্বের সাথে রেডিয়েশন বিকিরণের তীব্রতা হ্রাস পায়, তাই যতদূর সম্ভব ফোনটা আপনার শরীর থেকে দূরে রাখুন।
মোবাইল রেডিয়েশন এলাকায় কিভাবে নিজেকে সুরক্ষা করা যায়?
আপনি যদি রেডিয়েশন বিকিরণ এলাকায় বসবাস করেন, তাহলে নিজেকে সুরক্ষার জন্য সব সময় আপনাকে স্থানীয় এবং জাতীয় কর্তৃপক্ষের নির্দেশাবলী অনুসরণ করতে হবে এবং সর্বশেষ আপডেট পেতে তাদের সাথে সংযুক্ত থাকতে হবে।
মোবাইল ফোনে গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়া উচিত কি?
ঘুমানোর জন্য গান বা মিউজিক কে ব্যবহার করা যেতে পারে, তবে অবশ্যই মোবাইল ফোন বা স্মার্টফোন অন করে বা বাজিয়ে নয়। যদি এটি করা হয়, তাহলে অবশ্যই মোবাইলের রেডিয়েশন আপনার শরীরের ক্ষতি করতে পারে।
শিশুদের ক্ষেত্রে মোবাইল ফোন রেডিয়েশনে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি কি বেশি?
প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় শিশুদের শরীরে কিছু কোষ রয়েছে, যা খুব দ্রুত বিভাজিত হয়। বিভাজনকারী কোষগুলি রেডিয়েশনের প্রতি আরো বেশি সংবেদনশীল এবং ক্ষতিকর, যা ভবিষ্যতে ক্যান্সারের বিকাশ ঘটাতে পারে। সুতরাং শিশুদের ক্ষেত্রে মোবাইল ফোন রেডিয়েশন এর মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা অত্যান্ত বেশি।