ভূমিকা
অতি প্রাচীনকাল থেকে বাঙ্গালীরা পান্তা ভাত খেয়ে আসছে এবং বর্তমানেও এর কদর একেবারেই কম নয়। বিশ্বাস হচ্ছে না তো, আপনি খেয়াল করলে দেখবেন- বাঙালিরা পহেলা বৈশাখের সময় পান্তা ভাতের সাথে ইলিশ যোগ করে পান্তালিশ নামে যে সুষম খাবার তৈরি করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে, তা হয়তো একদিন আরো জনপ্রিয় হবে। বাঙালির খাদ্য সংস্কৃতিতে পান্তা ভাত একটি অনন্য খাবার। বাঙালি কবি সাহিত্যিকরা পান্তা ভাতকে তাদের নিজেদের সাহিত্যের মধ্যেও টেনে এনেছেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কিংবা পল্লী কবি জসিম উদ্দিন সকলেই তাদের সাহিত্যে পান্তা ভাতকে স্থান দিয়েছেন। যাইহোক পান্তা ভাতকে নিয়ে অতি প্রাচীনকাল থেকে অনেকেই অনেক গল্প কথা লিখে গেছেন। আমাদের বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও পান্তা ভাতের একজন ভক্ত ছিলেন সেটা তার জীবনচরিত “জীবনস্মৃতি’ থেকে জানা যায়। সেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন “ইসকুল থেকে ফিরে এলেই রবির জন্য থাকে নতুন বৌঠানের আপন হাতের প্রসাদ। আর যেদিন চিংড়ি মাছের চচ্চড়ির সঙ্গে নতুন বৌঠান নিজে মেখে দেয় পান্তা ভাত, অল্প একটু লঙ্কার আভাস দিয়ে সেদিন আর কোন কথা থাকে না।' পান্তা ভাত নিয়ে আর একটি মজার ইতিহাসও শোনা যায়। মুঘল আমলে ইংরেজরা তাদের বাণিজ্যিক চুক্তি ভঙ্গ করলে ১৯৫৬ সালে নবাব সিরাজউদ্দৌলা কলকাতা আক্রমণ করেন এবং তৎকালীন ইংরেজ গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিং সহ অনেক ইংরেজকে বন্দী করেন। পরে সেই সময়কার ওলন্দাজ কুঠির প্রধানের অনুরোধে সিরাজউদ্দৌলা হেস্টিং সাহেবকে ছেড়ে দেন। কিন্তু ওয়ারেন হেস্টিং গোপনে নবাবের তথ্য পাচার করছে, এই অভিযোগ উঠলে পুনরায় নবাব সিরাজউদ্দৌলা ওয়ারেন্ট হেস্টিংকে বন্দী করতে চাইলে, ভয়ে হেস্টিং সাহেব কাসিমবাজারে একজন জনৈক ব্যবসায়ী কৃষ্ণকান্ত নন্দী এর দোকানে লুকিয়ে পড়েন। ব্যবসায়ী কৃষ্ণকান্ত নন্দীর সাথে হেস্টিং এর সখ্যতা হয় এবং কৃষ্ণকান্ত নন্দী হেস্টিংকে চিংড়ি মাছের সাথে পান্তা ভাত খেতে দেন। হেস্টিং সাহেব উপায়ন্তর না পেয়ে, সেই পান্তা ভাত খেয়ে তার ক্ষুধা নিবারণ করেন। এই নিয়ে লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ে মজার ছড়া- "মুশকিলে পড়িয়া কান্ত করে হায় হায়/হেস্টিংকে কি খেতে দেবে প্রাণ রাখা দায়/ঘরে ছিল পান্তা ভাত আর চিংড়ি মাছ/কাঁচালঙ্কা বড়ি পড়া কাছে কলাগাছ/সূর্যোদয় হল আজ পশ্চিম গগনে/হেস্টিং ডিনার খান কৃষ্ণ কান্তের ভবনে।" অবশ্য কৃষ্ণকান্ত নন্দী এ কারণে হয়তো বিপুল ধন-সম্পদের মালিক হতে পেরেছিলেন।
আগের দিনে রাতে খাওয়ার পর বেঁচে যাওয়া ভাতকে পানি দিয়ে ভিজিয়ে রেখে দিয়ে পান্তা ভাতে পরিণত করা হতো। পহেলা বৈশাখের যে পান্তা ভাত তৈরি করা হয়, সেটি ভাত রান্না করে গরম ভাতে পানি দিয়ে অথবা গরম ভাত রান্না করে মাড়ি ভাত করে পান্তা করা হয়। কিন্তু আগের দিনের পান্তা ভাতের চাইতে পহেলা বৈশাখে তৈরি করা পান্তা ভাতে খাদ্যগুণ অনেক কম বলে পুষ্টি বিদগণ মনে করেন। ভাত মূলত পুরোটাই Carbohydrate বা শর্করা জাতীয় খাবার। ভাতে পানি দিয়ে রাখলে বিভিন্ন গাজনকারী ব্যাকটেরিয়া বা ইস্ট শর্করা ভেঙ্গে ইথানল ও ল্যাকটিক এসিড তৈরি করে। এই ইথানলিই পান্তা ভাতের ভিন্ন রকম স্বাদের জন্য দায়ী।
পান্তা ভাত মূলতঃ ভাতকে সংরক্ষণের একটি পদ্ধতি, এই ভাতকেই রেখে দিলে বা অনেক বেশি সময় ধরে(২-৩দিন) ভিজিয়ে রেখে দিলে তা পচন ধরে এবং খাওয়ার অনুপযোগী হয়ে পড়ে। আবার সেই ভাতকেই পানি দিয়ে(১২-১৮ঘন্টা) রাখলে গাজনকারী ব্যাকটেরিয়া সেখানে ল্যাকটিক এসিড তৈরি করে, যার ফলে পান্তা ভাতের অম্লত্ব বেড়ে যায়, এ কারণেই পচনকারী ও অন্যান্য ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক ভাতকে নষ্ট করতে পারে না। ভাতকে ভিজিয়ে রাখার পর ১২ থেকে ১৮ ঘন্টার মধ্যেই তা পান্তা ভাতে পরিণত হয়। পান্তা ভাত ভালোভাবে তৈরি করতে এবং এটিকে কোন প্রকার সংক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য যে পাত্রে ভাতে পানি দিয়ে রাখা হবে সেটি ভালো করে ঢেকে রাখত হবে। যাতে কোন সংক্রমণ ভাতের মধ্যে যেতে না পারে। সারা রাত ভিজিয়ে রাখার পর সকালবেলা পান্তা ভাত কাঁচা মরিচ, লবণ এবং পেঁয়াজ দিয়ে খাওয়া যেতে পারে। অতিরিক্ত স্বাদ গ্রহণের জন্য পান্তা ভাতের সাথে ইলিশ মাছের ভাজা কিংবা চিংড়ি মাছের চচ্চড়ি সহ কাঁচালঙ্কা, লবণ দিয়েও আপনি টেস্ট করে দেখতে পারেন।
পান্তা ভাতের ইংরেজি নাম
আপনি কি জানেন, পান্তা ভাতের ইংরেজি কি? যদি না জেনে থাকেন, তাহলে আজকের লেখা থেকে আপনি এই তথ্যটি জেনে নিতে পারবেন। সাধারণত বাংরেজিতে(বাংলা+ইংরেজি=বাংরেজি)পান্তা ভাতের ইংরেজি হওয়া উচিত ওয়াটার রাইস (Water Rice)। কিন্তু না, পান্তা ভাতের ইংরেজি নাম আছে। পান্তা ভাত যেহেতু সারারাত ভিজিয়ে রাখা হয়, সেহেতু ইংরেজদের ভাষায় এটিকে ফার্মেন্টেড রাইস(Fermented Rice) বলা হয়। আবার কেউ কেউ পান্তা ভাতের অর্থ দিক থেকে “বয়েল্ড রাইস স্টেপড ইন কোল্ড ওয়াটার(Boiled rice steeped in cold water)- এর ইংরেজি অর্থ কে ‘পান্তা ভাত’ বলে থাকেন। অর্থ গত দিক থেকে ইংরেজিতে পান্তা ভাতের একাধিক নাম থেকে থাকলেও আমাদের পান্তা ভাত যেহেতু বাঙালি খাবার, সেহেতু পান্তা ভাতের ইংরেজি নাম বাংরেজি এর মত করেই রাখা উচিত। আর সেটি হতে পারে- Panta vatt বা Panta rice অথবা Pantha vatt বা Pantha rice অথবা Water rice ইত্যাদি। প্রিয় পাঠক, আপনারা কি বলেন? এবার চলুন জানতে, কি উপকার পান্তা ভাতে?
পান্তা ভাতের উপকারিতা
আমরা বাঙালিরা সবাই জানি- ‘ পান্তা ভাত আমাদের অনেক প্রাচীন একটি খাবার। এই পান্তা ভাতের আবিষ্কার কবে, কোথায়, কিভাবে এবং কে করেছিলেন তা এখনো সঠিকভাবে বলা মুশকিল। রাতে রান্না করে খাওয়ার পরে যেটুকু ভাত অবশিষ্ট থাকে, সেই ভাতে পানি দিয়ে সকাল পর্যন্ত রাখলে সেটা পান্তা ভাতে পরিণত হয়। আগের দিনে কোন আত্মীয়-স্বজন বেড়াতে আসলে চা, বিস্কিট, রুটি-পরোটা ও ডিমের অমলেট দিয়ে অতিথিদেরকে আপ্যায়ন করার পরিবর্তে পান্তা ভাত খাইয়ে তাদেরকে আতিথেয়তা করার প্রচলন ছিল। কিন্তু বর্তমানে ডিমের অমলেট, রুটি-পরোটা, চা, বিস্কিট খাইয়ে আপ্যায়ন করা হয়। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে, পান্তা ভাতে অনেক উপকারী গুণ রয়েছে যা অনেকে জেনে অবাক হবেন। এবার চলুন, পান্তা ভাতে সেই উপকারী গুণ সম্পর্কে জেনে নেই।
শরীরকে শীতল রাখতে
পান্তা ভাত অথবা ভাত ভেজানো জল খেলে, শরীরের পানি শূন্যতা রোধ হয়। প্রচন্ড তাপদাহ রৌদ্র থেকে আসার পর, আপনি যদি পান্তা ভাত খেয়ে নেন, তাহলে দেখবেন একটু পরে আপনার শরীর শীতল হয়ে গেছে, আপনি শরীরের স্বস্তি পাচ্ছেন।
হজম শক্তি বৃদ্ধি ও ত্বক ভালো রাখতে
পান্তাভাতে রয়েছে- প্রচুর উপকারী ব্যাকটেরিয়া, যা আমাদের খাদ্য হজমে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। এছাড়া পরিপাক যন্ত্রের আলসার নিরাময়ে এবং পেট পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে পান্তা ভাত। পুষ্টি গবেষকদের মতে- ত্বকের ইলাস্টিসিটি রক্ষা করা এবং নতুন কোষ তৈরি করার জন্য রাসায়নিক উপাদান কোলাজেন প্রয়োজন, যা পান্তা ভাত থেকে আমরা পেতে পারি।
শরীরের রাসায়নিক খনিজকে শোষণে বাধা
গবেষকরা বলছেন, পান্তা ভাতে আছে ফাইটিক অ্যাসিড, যা বিভিন্ন খনিজ পদার্থ, লবণ, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত থাকে এবং এই সমস্ত রাসায়নিক খনিজ লবণকে দেহে শোষণে বাধা দেয়। ভাতকে সারারাত ভিজিয়ে রাখলে তাতে শর্করা গজানোর ফলে ল্যাকটিক অ্যাসিড তৈরি হয়, যা ভাতের সকল খনিজ লবণকে হাজার গুনে বাড়িয়ে দেয়।
রক্তস্বল্পতা দূর করতে
প্রতি ৫০০ গ্রাম সাধারণভাবে ভাতে আমরা যে পরিমাণ আয়রন পাই, ১২ ঘন্টা ভেজানোর পর পান্তা ভাতে সেই আয়রন ১৭ মিলিগ্রাম থেকে বেড়ে ৩৬৯.৫৫ মিলিগ্রাম হয়। কাজেই গবেষকদের ধারণা, যাদের রক্তস্বল্পতা আছে তারা পান্তা ভাত খেতে পারেন।
ক্যালসিয়ামের অভাব পূরণ
প্রতি ৫০০ গ্রাম ভাতের মধ্যে ক্যালসিয়াম পাওয়া যায় ১০৫ মিলিগ্রাম। কিন্তু সেই পরিমাণ ভাতকে যখন পান্তাতে পরিণত করা হয়, তখন সেখানে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪ হাজার ২৫০ মিলিগ্রাম। কাজেই পান্তা ভাত হতে পারে শরীরে ক্যালসিয়ামের অভাব পূরণের একটি অন্যতম উপায়।
পটাশিয়াম ও সোডিয়াম এর অভাব পূরণ
পান্তাভাতে সোডিয়াম এর পরিমাণ কমে ৪৭৫ মিলিগ্রাম থেকে ৩০৩ মিলিগ্রাম হয় এবং জিংক এর পরিমাণ বেড়ে যায়। এছাড়া পান্তা ভাতে প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়ামের মাত্রা থাকার কারণে যাদের উচ্চ রক্তচাপ আছে, তাদের জন্য উপকারী হতে পারে।
ভিটামিন এর অভাব পূরণ
গবেষণায় দেখা গেছে- পান্তা ভাতে ভিটামিন বি৬,বি১২ এর মত খাদ্য উপাদান পর্যাপ্ত থাকার কারণে ভিটামিনের অভাব পূরণ হয়। এছাড়া আমাদের শরীরে অম্ল ও ক্ষারের অসমতার কারণে বিভিন্ন ধরনের রোগ ব্যাধি আক্রমণ করে। পান্তা ভাতে রয়েছে শরীরের অম্ল ও ক্ষারের সমতা রক্ষাকারী উপকরণ, যা চা ও কফির চেয়ে অনেক গুনে ভালো।
শেষ কথা
পান্তা ভাতের ইংরেজি শব্দ যাই হোক না কেন, নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখে প্রতিটি বাঙালির পান্তা-ইলিশ যেন চাই-ই চাই। তবে সাধারণ চাউল থেকে লাল চাউলের পান্তা ভাত খুবই সুস্বাদু এবং পুষ্টি গুনে ভরপুর। আগের দিনে মানুষ ঢেঁকিতে ছাঁটা চাউলের পান্তা খেয়ে সকল ধরনের কাজকর্ম সাচ্ছন্দে করতে পারতেন। সেই সকল ঐতিহ্য হয়তো আজকে হারিয়ে যেতে বসেছে, চলুন সবাই মিলে রক্ষা করার চেষ্টা করি বাঙালির এই প্রাচীন ঐতিহ্যকে।
লেখাটি লিখেছেন
অচিন্ত মিঞ্জি
কনটেন্ট রাইটার
প্রিয় পাঠক, এই লেখাটি বিভিন্ন তথ্যসূত্র থেকে সংগৃহীত। এই বিষয়ে কোন মতামত থাকলে অথবা কোন তথ্য সংযোজন-বিয়োজনের প্রয়োজন হলে আমাদেরকে লিখে জানার অনুরোধ রইলো।