জয়েন্ট ব্যাথা বা বাত রোগের সেরা হোমিওপ্যাথিক ঔষধ

ভূমিকা

আপনি কি আপনার শরীরে জয়েন্টের ব্যথা বা শরীরে ব্যথা অনুভব করছেন? আপনার চলাফেরাকে কিংবা দৈনন্দিন কাজকর্ম সম্পাদন করতে ব্যাঘাত সৃষ্টি করার মতো উপসর্গ গুলো বা অসুবিধা গুলো আপনাকে কষ্ট দিচ্ছে প্রতিনিয়ত? যদি তাই হয়ে থাকে, তবে এই ধরনের লক্ষণ বা উপসর্গের জন্য শুধু আপনি নন, বিশ্বব্যাপী লক্ষ লক্ষ মানুষকে প্রভাবিত করছে এই সাধারণ ব্যাধিটি। এই সকল উপসর্গ গুলোর সাথে আরো কিছু উপসর্গ যদি আপনার থেকে থাকে তাহলে আপনি হয়তো আর্থ্রাইটিস বা জয়েন্ট ব্যথা বা বাত রোগ সমস্যায় ভুগছেন। আজকের আর্টিকেলে আমরা বাত রোগ কি এর লক্ষণ প্রতিকার ও হোমিওপ্যাথিক নিরাময় সম্পর্কে আলোচনা করব।

বাত রোগ কি?

বাত রোগ হল শরীরের জয়েন্ট বা অস্থি সন্ধির প্রদাহ যা, এক বা একাধিক অস্থিসন্ধিকে আক্রান্ত করে। মানুষের শরীরে অনেকগুলো জয়েন্ট বা সন্ধি বা জোড়া আছে। এইসব সন্ধিগুলোতে বা জয়েন্ট গুলিতে যদি কোন প্রদাহ বা ইনফ্লামেশন হয়, তবে তাকে বাত রোগ বলে। অর্থাৎ মানুষের শরীরে অনেকগুলো জোড়া বা সন্ধির বিভিন্ন রোগ বা সমস্যাকে একসাথে আর্থ্রাইটিস বা বাত রোগ বলে।

প্রকারভেদ 

বিশেষজ্ঞদের মতে প্রায় ১০০ রকমের আর্থ্রাইটিস রয়েছে। তবে নিম্নলিখিত আর্থাইটিস গুলো সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। এগুলো হল-

  • অস্টিও আর্থাইটিস
  • রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস
  • এনকালজিং 
  • স্পন্ডাইলসিস
  • গাউট
  • জুভেনাইল আর্থ্রাইটিস(বাচ্চাদের ক্ষেত্রে বেশি দেখা যায়)
  • রি-একটিভ আর্থ্রাইটিস
  • সেপটিক আর্থ্রাইটিস
  • স্কে-রোডারমা আর্থ্রাইটিস
  • এসএলআই

তবে এই সকল আর্থাইটিস এর মধ্যে অস্ট্রিও আর্থ্রাইটিস, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস ও ক্রিস্টাল আর্থ্রাইটিস সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। আবার বাত রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে-সমগ্র বাত রোগকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়, যেমন নন ইনফ্লেমেটরি ও ইনফ্লেমেটরি। কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় বাতের ব্যথায় বিশ্রাম নিলে কমে যায় এবং হাঁটা চলা করলে বৃদ্ধি পায় এগুলো হলো ইনফ্লামেটরি আর্থাইটিস। সাধারণ হাঁটু ব্যথা এই জাতীয় সমস্যার মধ্যে পড়ে। ইনফ্লামেটরি আর্থ্রাইটিস হল রিউমাটয়েড আর্থাইটিস এর অন্তর্ভুক্ত বাতরোগ। এই ক্ষেত্রে শরীরের শির দাঁড়ায় সাধারণত কোন সমস্যা হয় না।

আর্থাইটিস এর কারণ

বিশেষজ্ঞদের মতে- বাত রোগের সবচেয়ে বড় কারণ হলো, ইউরিক অ্যাসিড এর আধিক্য। খাবারের মাধ্যমে বিশেষ করে লাল মাংস, প্রক্রিয়াজাত খাবার, চর্বিযুক্ত খাবার ইত্যাদি যখন অধিক পরিমাণে গ্রহণ করা হয়, তখন এগুলোর মধ্যে থাকা ইউরিক এসিডকে শরীরের কিডনি ভালোভাবে ফিল্টার করতে পারে না। ফলে এই ইউরিক এসিড শরীরের অস্থিসন্ধি বা গাঁট গুলোতে ক্রিস্টালরুপে জমা হতে থাকে এবং ফুলে যায়, ব্যথা হয় ও শক্ত হয়ে যায়। সময় গড়ানোর সাথে সাথে এই রোগটি জটিল থেকে জটিলতর উপসর্গ হিসেবে দেখা দেয়। আমাদের দেশে এই রোগটি পুরুষদের ৪০ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে বেশি দেখা যায় এবং মহিলাদের রজঃনিবৃতির পর অর্থাৎ ৪৫ বছর বয়সে বেশি দেখা যায়। শিশু-কিশোরদের ক্ষেত্রে জুভেনাইল আর্থ্রাইটিস বেশি হতে দেখা যায়।

এছাড়া কোন কারণে শরীরের রোগ প্রতিরোধক শক্তি কমে গেলে আর্থ্রাইটিস হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। সেই সাথে উচ্চ শক্তির এন্টিবায়োটিক ঔষধ সেবন করা কিংবা তেজস্ক্রিয় কোন ঔষধ সেবন করার কারণেও আর্থ্রাইটিস হতে পারে। আবার যে সকল কারণে আর্থাইটিস দেখা যায় সেগুলো হল-
  • পরিবারের পূর্বপুরুষ কোন সদস্যের আর্থাইটিস রোগ থেকে থাকলে
  • ঋতু পরিবর্তনের প্রভাবে বা অতিরিক্ত ঠান্ডা লাগার কারণে 
  • সন্ধিস্থলে আঘাত লাগার কারণে
  • ভিটামিন ডি এর অভাবে
  • দেহের ওজন অতিরিক্ত বৃদ্ধি পেলে
জয়েন্ট ব্যাথা বা বাত রোগের সেরা হোমিওপ্যাথিক ঔষধ

কোন কোন খাবারে জয়েন্ট ব্যথা বৃদ্ধি পায় 

ভাজা বা প্রক্রিয়াজাত কোন খাবার

আপনার বাতের ব্যথা থেকে থাকলে প্রক্রিয়াজাত কোন খাবার (যেমন নুডুলস, চিপস, বিস্কিট, কেক, ফাস্টফুড এর খাবার, চকলেট ইত্যাদি) ও ভাজাপোড়া খাবার এড়িয়ে চলুন। এতে বাতের ব্যথা হঠাৎ বৃদ্ধি পেতে পারে।

চিনি ও মিষ্টি যুক্ত খাবার 

বাতের ব্যথার জন্য চিনি ও মিষ্টি যুক্ত খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস এর ব্যাথা বৃদ্ধির জন্য চিনি ও মিষ্টি যুক্ত খাবার একেবারেই বন্ধ করে দিন।

আইসক্রিম ও কোমল পানীয়

আইসক্রিম ও কোমল পানীয়তে চিনির পরিমাণ একটু বেশি থাকে, ফলে এগুলো খেলেও আপনার বাতের ব্যথা দ্রুত বাড়তে পারে।

আটা ও ময়দা যুক্ত খাবার

আটা ও ময়দা দিয়ে তৈরি খাবারগুলো এবং ভাত বাতের ব্যথা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। তাই এগুলো পরিমিত খাওয়ার চেষ্টা করুন।

ডিমের কুসুম

ডিমের কুসুম আর্থাইটিস এর ব্যথা বাড়তে পারে কারণ ডিমের কুসুমে রয়েছে অ্যারাকিডনিক অ্যাসিড। এই ফ্যাটি অ্যাসিডটি আর্থ্রাইটিস রোগের জন্য ক্ষতিকর। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন ডিমের সাদা অংশ খাওয়া যেতে পারে।

আর্থাইটিস রোগীদের কি ধরনের খাবার খাওয়া উচিত

যারা আর্থাইটিস রোগে ভুগছেন তাদের জন্য ভিটামিন ডি ও সি সমৃদ্ধ খাবার বেশি পরিমাণে খেতে হবে। তবে পরিমিত অবস্থায় অথবা আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ মতে এই সকল খাবার খেতে পারেন। 

শীতে আর্থ্রাইটিস এর ব্যথা কেন বেশি হয়? 

চিকিৎসকদের ব্যাখ্যা হল- অলস ভাবে জীবন যাপন করলে অথবা কাজকর্ম কম করলে শরীরের টিস্যু বা হাড়ের সংযোগস্থলে ইউরিক এসিড জমতে থাকে এবং সেটি শক্ত হতে থাকে। কিছুক্ষণ চলাফেরা করলে অথবা ব্যায়াম করলে সেই শক্ত বা আড়ষ্ট ভাবটা চলে যায়। কিন্তু শীতের সময় সেই চলাফেরা বা ব্যায়াম করার অভ্যাসটা কম থাকে। এ কারণেই যাদের শরীরের মধ্যে ইউরিক অ্যাসিডের পরিমাণটা বেশি আছে, তাদের ক্ষেত্রে শীতের সময় বাতের ব্যথাটা বেশি হয়।


আর্থাইটিস এর লক্ষণ সমূহ 

১। এক বা একাধিক জয়েন্ট গুলো ব্যথা অনুভূত হয় ও ফুলে যেতে পারে

২। দৈনন্দিন কাজকর্ম ও চলাফেরায় অসুবিধা হতে পারে, জয়েন্টগুলো ফুলে যেতে পারে, গরম হতে পারে, নড়াচড়ায় ব্যথা হতে পারে

৩। শরীরের ক্লান্ত বোধ, হতাশা, অবসাদ, অনিদ্রা এবং অনেক সময় জ্বর হতে পারে

বাত রোগের জটিলতা সমূহ

এই রোগ হলে এবং এর যথোপযুক্ত চিকিৎসা করা না হলে শরীরের সন্ধি বা জয়েন্ট এর শক্তি কমে যায়, ফলে রোগী নড়াচড়া করতে পারে না এবংজয়েন্ট গুলো সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে রোগী পঙ্গু হয়ে যায়। অনেক সময় দীর্ঘদিন এই রোগে ভোগার পর শরীরের মাংসপেশিগুলো শুকিয়ে যায়।

বাত রোগের সেরা হোমিওপ্যাথিক ঔষধ সমূহ

আর্নিকা মন্টেনা- বাত বা জয়েন্টের ব্যথার জন্য এই ঔষধটি হোমিওপ্যাথিতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এই ঔষধের অন্যতম লক্ষণ হল আঘাত লাগার কারণে যদি বাত রোগ হয়ে থাকে, তাহলে এই ঔষধটি ব্যবহার করা হয়। 

রাসটক্স- বাত রোগের রোগীর অস্থিরতা বেশি হলে এবং সেই সাথে পানির পিপাসা থাকলে এই ঔষধটি আর্থ্রাইটিস এর জন্য একটি উপযোগী ঔষধ। আক্রান্ত স্থান শক্ত হয়ে যাওয়া, ফুলে যাওয়া ইত্যাদি লক্ষণ দেখে এই ঔষধটি ব্যবহার করা হয়। 

ক্যালকেরিয়া কার্ব- অস্টিও আর্থ্রাইটিস এর জন্য এই ওষুধটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জয়েন্টের গভীর অংশে হালকা ফোলা ভাব, ব্যথা ইত্যাদি উপসর্গ দেখে এই ঔষধটি রোগীকে সেবনের জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়।

ক্যালিমিয়া- ক্যালিমিয়া ঔষধের লক্ষণ হল ছিঁড়ে যাওয়ার মত ব্যথা অনুভূত হওয়া কিন্তু এই ঔষধে তত বেশি ফোলা ভাব থাকে না। তবে এই ঔষধের আর একটি অন্যতম লক্ষণ হলো এর ব্যথা সর্বদাই স্থান পরিবর্তন করে।

রডোডেনড্রন- বাতের ব্যথা বজ্রপাতের আগে বা সময়ে বেশি অনুভূত হলে এবং জয়েন্টের ফোলা ভাব থাকলে এই ঔষধটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

ব্রায়োনিয়া আলব- নড়াচড়ার সাথে ব্যথা-বৃদ্ধি ভাব বেশি থাকলে ব্রায়োনিয়া আলব ঔষধটি ব্যবহার করা হয়।

কলচিকাম- এই ঔষধটি গেটে বাতের ব্যথার জন্য একটি দুর্দান্ত ঔষধ। আক্রান্ত স্থান ফোলা, লাল বা ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া, অত্যন্ত ব্যথা, ব্যথা জয়েন্ট থেকে জয়েন্টে স্থানান্তর হওয়া ইত্যাদি লক্ষণে সফলতার সাথে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

এছাড়াও হোমিওপ্যাথিতে আরো যে সকল ঔষধ গুলো সফলতার সাথে ব্যবহার করা হয়ে থাকে সেগুলো হল লিডাম পাল, কস্টিকাম, পালসেটিলা, এপিস মেল।

উপসংহার

আর্থ্রাইটিস বা বাত রোগের যন্ত্রণা অত্যন্ত কষ্টদায়ক। এই কষ্টদায়ক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ঔষধ সেবন এর পাশাপাশি খাদ্য গ্রহণে আনতে হবে পরিবর্তন। শুধু খাদ্য গ্রহণে পরিবর্তন আনলেই চলবে না, আবার শুধুমাত্র ওষুধের উপর নির্ভর করে থাকলে এই কষ্টদায়ক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব হবে না, যদি না এই আর্থাইটিস বা বাত রোগকে আপনি প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেন। এই জন্য আপনাকে সামগ্রিকভাবে বাত রোগের অস্বস্তি দূর করার জন্য নিয়মিত ব্যায়াম, আপনার চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ, খাদ্য গ্রহণে সংযত হতে হবে। মনে রাখবেন আপনি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলেই এই রোগ থেকে সহজে নিরাময়ের দিকে এগিয়ে যাবেন। আর একটি কথা বলতেই হয়, আপনি যদি হোমিওপ্যাথিক ঔষধ সেবন করেন, তাহলে কখনোই নিজে নিজে ঔষধ সেবন করবেন না, এতে আপনার রোগের জটিলতা বৃদ্ধি পেতে পারে। তাই সবচেয়ে ভালো হলো, আপনি যদি একজন অভিজ্ঞ হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক এর পরামর্শ মোতাবেক ঔষধ সেবন করেন তাহলেই আপনার রোগের উপশম করা দ্রুত সম্ভব। এছাড়া এই রোগের উপশমের জন্য আপনাকে প্রচুর পানি খেতে হবে, নিয়মিত ব্যায়াম ও সুষম খাবার গ্রহণ করার সাথে সাথে আপনার শরীরের ওজনটাকে শরীরের উচ্চতা ও বয়স অনুযায়ী ঠিক রাখতে হবে।






একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন