ভূমিকা
বাংলাদেশ মেট্রো রেল, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু টানেল, সৌর বিদ্যুৎ থেকে পারমাণবিক বিদ্যুৎ, পদ্মা সেতু ইত্যাদি দীর্ঘমেয়াদী সব অবকাঠামো নির্মাণ এবং আধুনিক তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের দিক দিয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে। এ যেন স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে একটি পূর্ব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের চরম সাহসিকতা। ডিজিটাল বা স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার আর একটি স্মরণীয় এবং ঐতিহাসিক উদ্যোগ বাংলাদেশের নিজস্ব জাতীয় কার্ড স্কিমের আওতায় 'টাকা পে’ কার্ড চালু করা। আজকের আর্টিকেলে আমরা টাকা পে কার্ড কি এবং এর সুবিধা ও অসুবিধা গুলো জানার চেষ্টা করব।
কি এই 'টাকা পে’ কার্ড?
'টাকা পে'- কার্ড হচ্ছে এক ধরনের আর্থিক লেনদেন এর জন্য ব্যাংক কর্তৃক ইস্যুকৃত কার্ড, যার মাধ্যমে প্রচলিত ভিসা বা মাস্টার কার্ড এর মত লেনদেন করা যাবে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন ব্যাংক এই কার্ড ইস্যু করতে পারবে কিন্তু এর সকল নিয়ন্ত্রণ থাকবে বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে। অর্থাৎ এটি হবে ভিসা, মাস্টার কার্ড ও আমেক্সের মত আন্তর্জাতিক কার্ড সেবার একটি স্থানীয় বিকল্প ব্যবস্থা।
টাকা পে কার্ড চালু করার উদ্দেশ্য
আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর নির্ভরশীলতা কমানো এবং বৈদেশিক মুদ্রার উপর হ্রাস কমানোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ন্যাশনাল ডেবিট কার্ড বা Takapay কার্ড চালু করেছে। গত ১ নভেম্বর ২০২৩ বুধবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই 'জাতীয় টাকা পে কার্ড (ন্যাশনাল ডেবিট কার্ড) উদ্বোধন করেন। টাকা পে কার্ড এ লেনদেন নিষ্পত্তি হবে শুধু বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীন এনপিএসবি (ন্যাশনাল পেমেন্ট সুইচ অফ বাংলাদেশ) এর মাধ্যমে।
টাকা পে কার্ড কিভাবে কাজ করবে?
লেনদেন সহজ এবং নিরাপদ করতে Takapay Card এর যাত্রা শুরু। টাকা পে কার্ড এর গ্রাহকরা অনলাইন, অফলাইন এবং মোবাইল ব্যাংকিং যেকোনো মাধ্যমে লেনদেন খুব সহজে করতে পারবেন।
- অনলাইনে -লেনদেন করার জন্য এর গ্রাহককে শুধুমাত্র তার নিজের কার্ডের তথ্য প্রদান করতে হবে।
- অফলাইনে-লেনদেন করার জন্য গ্রাহককে কার্ডটিকে পয়েন্ট অফ সেলস(POS) মেশিনে প্রবেশ করাতে হবে এবং পিন নাম্বার প্রদান করতে হবে।
- মোবাইল ব্যাংকিং- লেনদেন করার জন্য গ্রাহককে কার্ডের তথ্য মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাপে প্রবেশ করাতে হবে।
টাকা পে কার্ড এর সুবিধা
খরচ কম- টাকা পে কার্ড এর মাধ্যমে লেনদেন করা হলে খরচ, ভিসা বা মাস্টার কার্ডের তুলনায় অনেক কম হবে। কারণ ভিসা কার্ড বা মাস্টার কার্ড ব্যবহার করতে যে ফি প্রদান করা হয়; তার চাইতে তুলনামূলক কম খরচে বা কম ফি প্রদান করে এই কার্ড ব্যবহার করা যাবে।
দেশীয় নিয়ন্ত্রণ- টাকা পে কার্ড এর লেনদেন সম্পূর্ণ দেশীয় নিয়ন্ত্রণাধীনে পরিচালিত হবে। এ কারণে বিদেশী কার্ড সেবা দাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর নির্ভরতা কমবে।
নিরাপদ ও সহজে লেনদেন- টাকা পে কার্ডটির সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে। এখানে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ থাকায় খুব সহজে অল্প সময়ের মধ্যে এবং নিরাপদে লেনদেন কার্যক্রম সম্পাদন করা যাবে।
গ্রহণযোগ্যতা- সহজ এবং নিরাপদ লেনদেন এর কারণে টাকা পে কার্ডটি অল্প সময়ের মধ্যেই জনপ্রিয় হয়ে উঠবে বলে অনেকেই ধারণা করছেন। সেই সাথে POS (পয়েন্ট অফ সেলস) মেশিন এর চাহিদা দিনকে দিন বৃদ্ধি পাবে।
টাকা পে কার্ড এর অসুবিধা
নতুন প্রযুক্তি- নতুন প্রযুক্তি হওয়ার কারণে অনেকের কাছে এটি ব্যবহার করতে কঠিন বলে প্রতিয়মান হবে এবং প্রথম অবস্থায় তুলনামূলক কম গ্রাহক ব্যবহার করবে।
সীমিত গ্রহণযোগ্যতা- প্রাথমিক অবস্থায় Takapay Card টি শুধুমাত্র বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ব্যবহার করা যাবে, বিধায় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এর তেমন কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না।
কবে নাগাদ পুরোপুরি চালু হবে জাতীয় টাকা পে কার্ড?
বিভিন্ন সূত্রের মাধ্যমে জানা যায়- প্রাথমিকভাবে চলতি বছরের গত সেপ্টেম্বর থেকে টাকা পে কার্ডটি চালুর পরিকল্পনা থাকলেও পরবর্তীতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর জানান চলতি বছরের ডিসেম্বর মাস নাগাদ পুরোপুরি চালু করা সম্ভব হবে জাতীয় টাকা পে কার্ড স্কিমটি। এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর কাজী সায়েদুর রহমান সহ একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। উক্ত কমিটিতে স্থানীয় ব্যাংক- ব্র্যাক ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, ডাচ-বাংলা ব্যাংক ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের প্রতিনিধি রয়েছেন। আর প্যারিস ভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ফিমকে টাকা পে কার্ড প্রস্তুত করতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
কিভাবে পাওয়া যাবে Takapay Card কার্ড
প্রাথমিকভাবে তিনটি ব্যাংক- ব্র্যাক ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক টাকা পে কার্ড চালু করলেও পরবর্তীতে ধাপে ধাপে অন্যান্য ব্যাংকগুলো জাতীয় টাকা পে কার্ড চালু করবে। এখানে প্রশ্ন হল- কিভাবে পাওয়া যাবে টাকা পে কার্ড। টাকা পে কার্ড পেতে হলে যে কোন ব্যাংকে একটি একাউন্ট থাকতে হবে এবং একাউন্ট খোলার সময় টাকা পে কার্ড নিতে সম্মত ব্যক্তি টাকা পে কার্ড ব্যাংক থেকে নিতে পারবেন।
টাকা পে কার্ড এর ভবিষ্যৎ
জাতীয় ডেবিট কার্ড বা টাকা পে কার্ড বিদেশী কার্ডের উপর নির্ভরশীলতা কমাবে এবং সেই সাথে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করতে সক্ষম হবে। দেশের সব এটিএম বুথ,পয়েন্ট অফ সেলস(POS) ও অনলাইন প্লাটফর্মে এই কার্ড ব্যবহার করা যাবে। টাকা পে কার্ড, ডেবিট কার্ড বা মাস্টার কার্ড হিসেবে ব্যবহার করা গেলেও ভবিষ্যতে Takapay Credit Card নিয়ে আসা হবে। তাছাড়া পরবর্তীতে প্রতিবেশী দেশ ভারতে এই কার্ডটি ব্যবহার করা যাবে এবং ভ্রমণ করার সময় সর্বোচ্চ ১২০০০ (বারো হাজার)ডলার পর্যন্ত এই কার্ডের মাধ্যমে খরচ করা যাবে। এছাড়া অদূর ভবিষ্যতে এই কার্ডটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হবে বলে বিভিন্ন তথ্যসূত্র থেকে জানা যায়।
শেষ কথা
ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা, ক্যাশলেস সোসাইটি প্রতিষ্ঠা, দুর্নীতিমুক্ত ও নিরাপদ লেনদেন প্রতিষ্ঠা, রাজস্ব আদায় ও বৈদেশিক মুদ্রা আয়ে সহযোগিতা করা, হার্ড কারেন্সি বা কাগজের টাকার উপর নির্ভরশীলতা কমানো ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যসমূহকে সামনে রেখে টাকা পে কার্ড প্রচলন করা হয়েছে। স্মার্ট বাংলাদেশের স্মার্ট লেনদেন সম্পূর্ণ করার জন্য বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আরো এগিয়ে গেল একধাপ বাংলাদেশ। ভবিষ্যতে টাকা পে কার্ড এর মাধ্যমে দেশের জনগণ দেশের অভ্যন্তরে ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খুব সহজেই আর্থিক লেনদেন কার্যক্রম নিরাপদ ও সহজে করতে পারবে এই প্রত্যাশা দেশের জনগণের। টাকা পে কার্ড বাংলাদেশের নিজস্ব পরিকল্পনা ও নকশায় তৈরি প্রথম জাতীয় পেমেন্ট স্কিম, যা ব্যাংকিং খাতে এক ঐতিহাসিক যুগের সূচনা করেছে। আন্তর্জাতিক পেমেন্ট স্কিমের উপর নির্ভরশীলতা কমাতে এবং বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ে, সার্বভৌম এই কার্ড বিশেষ ভূমিকা পালন করবে, এটাই দেশবাসীর প্রত্যাশা।