মেট্রোরেল উদ্বোধন ও উত্তরা, আগারগাঁও ও মতিঝিল এর ভাড়া

ভূমিকা

পরিবহন সেক্টরে একটি টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব হিসেবে পরিচিত ঢাকা মেট্রো রেল কার্বন নিঃসরণ ও বায়ুদূষণ এবং ভ্রমণের সবচেয়ে বিরক্তিকর যানজটকে পিছনে ফেলে দ্বিতীয়বারের মতো উদ্বোধন ঘোষণা করা হয়েছে। এর ফলে উত্তরা আগারগাঁও ও মতিঝিল পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় ২২ কিলোমিটার রাস্তা খুব কম সময়ের মধ্যে ঢাকা নগরবাসি এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ভ্রমন করতে পারবে। এতে কমবে ভ্রমণের সময় ও যানজটের ঝক্কি ঝামেলা। শনিবারে দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্বিতীয় বারের মতো উত্তরা আগারগাঁও ও মতিঝিল ঢাকা মেট্রোরেল সার্ভিসের দ্বিতীয় উদ্বোধন ঘোষণা করেন। উদ্বোধনের পর ঢাকা মেট্রো রেল এর প্রথম চালক মরিয়ম আফিজা প্রথম উদ্বোধনের সময় যিনি প্রধানমন্ত্রীকে বহন করেছিলেন এবং সকলের প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন, তিনিই দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রীকে মেট্রোরেল এ বহন করে আগারগাঁও থেকে মতিঝিলের উদ্দেশ্যে রওনা দেন শনিবার বিকেল ২ টা ৪১ মিনিটে এবং মতিঝিল পৌঁছান ৩টা ৬মিনিটে। মরিয়ম আফিজার গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলার রামগঞ্জ উপজেলার করপাড়া ইউনিয়নে। তিনি নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেমিস্ট্রি অ্যান্ড কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন।

প্রথম উদ্বোধন ও বাংলাদেশের মেট্রোরেলের যাত্রা শুরু

বাংলাদেশে মেট্রোরেলের যাত্রা শুরু হয় ২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর বুধবার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যিনি বাংলাদেশের দেশরত্ন এই মেট্রোরেলের আংশিক ও সীমিত আকারে চালুর জন্য উদ্বোধন করেন এবং উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর সবুজ পতাকা উড়িয়ে প্রথম ট্রেনটি যাত্রার শুভ সূচনা করেন। প্রথম ট্রেনটি চলে যাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী সবুজ পতাকাটিতে স্বাক্ষর করেন এবং দ্বিতীয় ট্রেনটিতে করে অন্যান্য অতিথিদের সাথে নিয়ে উত্তরা দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাঁও এর উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।

মেট্রোরেল উদ্বোধন ও  উত্তরা, আগারগাঁও ও মতিঝিল এর ভাড়া

দ্বিতীয় উদ্বোধন

একই প্রকল্পের আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত বাকি অংশ উদ্বোধনের জন্য ২০২৩ সালের অক্টোবর মাস ঘোষণা করা হয় এবং তারই ধারাবাহিকতায় ৪ নভেম্বর ২০২৩ এই প্রকল্পের আগারগাঁও মতিঝিল মেট্রো রেলের দ্বিতীয় উদ্বোধন এর জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়। এই দিন মেট্রোরেলের আগারগাঁও মতিঝিল রুটের মোট সাতটি স্টেশনের মধ্যে ফার্মগেট, সচিবালয় ও মতিঝিল এই তিনটি স্টেশন প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধন এর মাধ্যমে চালু করা হয়। বিজয় সরণি, কারওয়ান বাজার, শাহবাগ, টিএসসি ও প্রেস ক্লাব এই বাকি চারটি স্টেশন পর্যায়ক্রমে চালু করা হবে।


উত্তরা-দিয়াবাড়ি-মতিঝিল রুট, সময় ও স্টেশন সংখ্যা

ঢাকা মেট্রোরেলের দিয়াবাড়ি আগারগাঁও মতিঝিল রুটটি পুরোপুরি চালু হওয়ার ফলে যাত্রী সাধারণের উত্তরা দিয়াবাড়ি থেকে মতিঝিল পৌঁছাতে সময় লাগবে মাত্র ৩৮ মিনিট, যেখানে এর আগে একই রুটে সময় লাগতো দুই থেকে তিন ঘন্টা। মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষদের মতে- প্রাথমিকভাবে সব ট্রেন উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত যাবে না। প্রতি ১৫ মিনিট পরপর আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত পাঁচটি ট্রেন চলবে।এছাড়া প্রতিটি ট্রেনের একটি পরিচিতি নাম্বার দেওয়া থাকবে, যে নাম্বার দেখে সহজেই বুঝা যাবে, কোন ট্রেনটি আগারগাঁও যাবে আর কোনটি মতিঝিল যাবে। প্রকল্পটির পুরো সিস্টেমটি চালু হলে প্রাথমিকভাবে সকাল ৭টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত পরিষেবা পাওয়া যাবে এবং পরবর্তীতে সাড়ে ১১ টা পর্যন্ত তা বাড়ানো হবে। উত্তরা দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মোট স্টেশন ৯টি এবং আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত স্টেশন ৭টি। উত্তরা-আগারগাঁও-মতিঝিল রুটটি এখন চালু হলেও ডিএমআরটি-৬ পুরো প্রকল্প শেষ হতে সময় লাগবে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত অর্থাৎ মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত রুটটি শেষ হবে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর মাসে।

প্রকল্পের মোট ব্যয় ও সম্প্রসারণ

ঢাকা মেট্রো রেল কর্তৃপক্ষের মতে- ২০১৭ সালে গৃহীত ঢাকা মেট্রো রেল প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় ২১ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু পরবর্তীতে মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত অতিরিক্ত ১.৬ কিলোমিটার অংশ সংযোজন এর ফলে এবং প্রতিটি স্টেশনের জন্য নতুন জমি অধিগ্রহণের কারণে মেট্রোরেল প্রকল্পের মোট ব্যয় হচ্ছে ৩৩ হাজার ৪৭২কোটি টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার যোগান দিচ্ছে ১৩ হাজার ৭৫৩ কোটি টাকা, বাকি ১৯ হাজার ৭১৯ কোটি টাকা জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) প্রকল্পটির ঋণ আকারে অর্থ সহযোগিতা প্রদান করছে। পুরো প্রকল্পটি ২০২৫ সালের ডিসেম্বর মাসে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। 

উত্তরা আগারগাঁও ও মতিঝিল এর ভাড়া

ডিএমআরটি-৬ নামে পরিচিত উত্তরা আগারগাঁও ও মতিঝিল মেট্রো রেল উদ্বোধন করেছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৪ নভেম্বর ২০২৩ শনিবার বেলা ২:৩০ মিনিটে বহুল প্রতীক্ষিত আগারগাঁও মতিঝিল মেট্রো রেল সার্ভিসের রুটটি দ্বিতীয় ধাপের উদ্বোধন ঘোষণা করা হয়। সাধারণ জনগণের জন্য এই রুটে মেট্রোরেল সার্ভিসের পরিষেবা পাওয়ার জন্য ৫ নভেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। প্রথমে ফার্মগেট, সচিবালয় ও মতিঝিল স্টেশনের জন্য মতিঝিল অংশের মেট্রোরেল চলাচল শুরু করছে। পরবর্তীতে ধাপে ধাপে বাকি চারটি স্টেশন জনগণের জন্য খুলে দেওয়া হবে। জানা যায়- ৫ নভেম্বর সকাল সাড়ে ৭টা থেকে বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ চালিত দ্রুতগতির এই মেট্রোরেল চলাচল করবে। অর্থাৎ সকাল সাড়ে সাতটা থেকে বেলা সাড়ে ১১ টা পর্যন্ত মেট্রো রেল আগারগাঁও এর উভয় দিকে চলাচল করবে এবং সাড়ে এগারোটার পর শুধুমাত্র উত্তরা ও আগারগাঁও পর্যন্ত সারাদিন চলবে কিন্তু আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত বন্ধ থাকবে।

মেট্রো রেল পরিচালনার ব্যয় ও জনসাধারণের আর্থিক সামর্থ্যের উপর বিবেচনা করে মেট্রোরেল বিধিমালা ২০১৬ এর বিধি ২২ অনুসারে ভাড়া নির্ধারণ করেছে ডিটিসিএ। ডিটিসিএ- এর তথ্য অনুযায়ী যাত্রীর প্রতি কিলোমিটারের ভাড়া ৫ টাকা; সর্বনিম্ন ভাড়া ২০ টাকা এবং সর্বোচ্চ ভাড়া হবে ১০০ টাকা।

ঢাকা মেট্রো রেল এর ভাড়া বিষয়ে ডিটিসিএ এর তথ্য অনুযায়ী উত্তরা উত্তর স্টেশন থেকে মতিঝিল স্টেশনের ভাড়া ১০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া-

উত্তরা সেন্টার ও উত্তরা দক্ষিণ স্টেশন থেকে মতিঝিল এর ভাড়া- ৯০ টাকা
পল্লবী স্টেশন থেকে মতিঝিল স্টেশনের ভাড়া- ৮০ টাকা
মিরপুর ১১স্টেশন থেকে মতিঝিল স্টেশনের ভাড়া- ৭০ টাকা
মিরপুর ১০ ও কাজিপাড়া স্টেশন থেকে মতিঝিল স্টেশনের ভাড়া- ৬০ টাকা
শেওড়াপাড়া ও আগারগাঁও স্টেশন থেকে মতিঝিল স্টেশনের ভাড়া- ৫০ টাকা
ফার্মগেট স্টেশন থেকে মতিঝিল স্টেশনের ভাড়া- ৩০ টাকা
সচিবালয় স্টেশন থেকে মতিঝিল স্টেশনের ভাড়া- ২০ টাকা
আবার
মিরপুর ১০ নাম্বার থেকে ফার্মগেট স্টেশনের ভাড়া ৩০ টাকা কিন্তু কাওরান বাজার স্টেশনে যেতে ভাড়া লাগবে ৪০ টাকা 
মিরপুর ১০ স্টেশন থেকে শাহবাগ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশনের ভাড়া ৫০টাকা
মিরপুর ১০ থেকে সচিবালয় ও মতিঝিল স্টেশন এর ভাড়া ৬০টাকা

ফার্মগেট স্টেশন থেকে উঠে কাওরান বাজার অথবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এর ভাড়া লাগবে ২০ টাকা অর্থাৎ একটি স্টেশন থেকে আরেক স্টেশনের ভাড়া হবে সর্বনিম্ন ২০ টাকা। কিন্তু ফার্মগেট থেকে সচিবালয় ও মতিঝিল স্টেশনে ভাড়া হবে ৩০টাকা।

উপসংহার

ঢাকা মেট্রো রেল উদ্বোধন বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি অভূতপূর্ব মুহূর্ত যা দেশের জনগণকে একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। যানজট মোকাবেলা এবং টেকসই উন্নয়নে অবদান রাখা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে উৎসাহিত করা ইত্যাদি একটি উন্নয়নশীল দেশের অন্যতম নিয়ামক। আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে সরকার ঢাকা মেট্রোরেল এর পুরোপুরি সম্প্রসারণ সম্পূর্ণ ও সম্পাদন করতে পারবে বলে দেশের জনগণ আশাবাদী। 
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন