হাড় ক্ষয় প্রতিরোধ ব্যবস্থা ও হোমিওপ্যাথিক ঔষধ

হাড় ক্ষয় কি

হাড় ক্ষয় হল এমন একটি রোগ, যা হাড়ের ঘনত্ব এবং শক্তিকে দুর্বল করে দেয়। এই রোগ হলে শরীরের হাড় এর শক্তি লোপ পায় এবং অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ে, ফলে হাড় ভাঙ্গার ঝুঁকি অতিমাত্রায় বেড়ে যায়। এটিকে চিকিৎসা বিজ্ঞানে অস্টিওপোরোসিস বলা হয়ে থাকে। বিভিন্ন কারণে হাড়ের ক্ষয় বা অস্টিওপোরোসিস হতে পারে, তার মধ্যে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিনের অভাব, কিছু স্টেরয়েড জাতীয় ঔষধ সেবন, জেনেটিক অবস্থা, কিছু শারীরিক অবস্থা ইত্যাদি কারণে এ রোগ হতে পারে। অস্টিওথেরোসিস বা হাড় ক্ষয়ের লক্ষণগুলো প্রাথমিক পর্যায়ে লক্ষ্য করা যায় না, তবে হাড় ভাঙ্গার পরে এই লক্ষণগুলো প্রকাশ পেতে পারে। সাধারণত ৩৫ বছর বয়সের পর থেকে হাড়ের ঘনত্ব কমতে থাকে। তাছাড়া পুরুষদের চাইতে নারীদের হাড় ক্ষয়ের ঝুঁকি বেশি থাকে, কারণ নারীদের মাসিক চক্র বা রজঃ বন্ধের পর ইস্ট্রোজেন হরমোন এর মাত্রা হ্রাস পায়, যা হাড়ের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।


হাড় ক্ষয় প্রতিরোধ ব্যবস্থা ও হোমিওপ্যাথিক ঔষধ

হাড় ক্ষয়ের কারণ

বয়স বাড়ার সাথে সাথে বিশেষ করে ৩৫ বছরের পর আমাদের শরীরের হাড় ক্ষয়ের প্রবণতা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। যে সকল কারণে হাড় ক্ষয় বা অস্টিওপোরোসিস রোগ হয় চলুন সেই সম্পর্কে আমরা জেনে নেই-

ক্যালসিয়াম এবং ভিটামিন ডি এর অভাব
হাড়কে সুগঠিত করতে এবং শক্তিশালী করতে ক্যালসিয়াম এবং ভিটামিন ডি একটি অপরিহার্য রাসায়নিক উপাদান। হাড়ের মূল উপাদান হলো ক্যালসিয়াম। আবার ক্যালসিয়ামকে শোষণ করে ভিটামিন ডি। এ কারণেই বলা হয় ক্যালসিয়াম এবং ভিটামিন ডি এর অভাব হলে হাড় ক্ষয়ের ঝুঁকি অত্যন্ত বেড়ে যায়।

স্টেরয়েড ঔষধ বেশি মাত্রায় গ্রহণ
কিছু স্টেরয়েড ঔষধ অতিমাত্রায় গ্রহণ করা হলে হাড় ক্ষয়ের ঝুঁকি বাড়তে পারে; কারণ স্টোরোয়েড ঔষধ হাড়ের গঠন প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে এবং হাড়ের ক্ষয়কে ত্বরান্বিত করে। স্টোরোয়েড হল এক ধরনের হরমোন, যা মানব দেহে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হয়। এই স্টেরয়েড হরমোন ঔষধ গুলো প্রাদাহিক সম্পর্কিত সমস্যা হ্রাস করার জন্য তৈরি করা হয়েছে।

শারীরিক অবস্থা
শারীরিক অবস্থা বিশেষ করে হাইপার থাইরয়েডিজোম এবং থাইরয়েড ক্যান্সার অস্টিওপোরোসিস এর ঝুঁকি বাড়াতে পারে, কারণ শারীরিক এই অবস্থাগুলি হাড়ের গঠনকে বাধা প্রাপ্ত করে এবং হাড়ের ক্ষয়কে ত্বরান্বিত করে।

জেনেটিক অবস্থা
কিছু নির্দিষ্ট জেনেটিক অবস্থা হাড় ক্ষয়ের ঝুঁকি বাড়াতে পারে, কারণ হাড়ের গঠন এবং শক্তির জন্য প্রয়োজনীয় জিনগুলি কার্যকরী ভাবে কাজ করতে পারে না। 

বাতাসে নাইট্রাস অক্সাইড এর প্রভাব
নাইট্রাস অক্সাইড এমন একটি রাসায়নিক উপাদান, যা দূষিত বাতাসের মধ্যে অধিক মাত্রায় পাওয়া যায়। এই নাইট্রাস অক্সাইড হাড়ের ঘনত্বকে কমিয়ে দেয় বলে দাবি করেছে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা।

সেক্স হরমোন এর তারতম্য হলে  অস্টিওপোরোসিস বা হাড় ক্ষয় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। এছাড়া হাড় ক্ষয়ের অন্যতম প্রধান কারণ হলো- ভিটামিন ডি ও ক্যালসিয়াম এর অভাব। আবার শুধুমাত্র হরমোন ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি এর অভাব পূরণ করলেই হাড় ক্ষয় প্রতিরোধ সম্ভব এমনটি নয়, স্বাস্থ্যকর জীবন যাপন ও খাবারের নিয়ন্ত্রণ এর মাধ্যমে হাড় ক্ষয় রোগ প্রতিরোধ করা যেতে পারে।

হাড় ক্ষয়ের উপসর্গ সমূহ

হাড় ক্ষয়ের অন্যতম প্রধান উপসর্গ হলো কোমরে বা শরীরের কোন একটি অংশে সর্বক্ষণ ব্যথা হতে থাকবে। এছাড়া দেহের উচ্চতা হঠাৎ করে দ্রুত গতিতে কমতে থাকবে এবং খুব সামান্য কারণে বা আঘাতে শরীরের হাড় এর মধ্যে ভঙ্গুরতা সৃষ্টি হতে পারে। এছাড়া-
  • শরীরের মাংসপেশীতে ব্যথা অনুভূত হওয়া
  • মেরুদন্ড সহ সমস্ত শরীরের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে তীব্র ব্যথা হওয়া
  • হাড়ের গাঁটে বা জোড়ায় জোড়ায় ব্যথা অনুভূত হওয়া
  • কোমরের পিছনে বিশেষ করে নিতম্বে, মেরুদন্ডে, পাঁজর কিংবা কব্জিতে তীব্র ব্যথা অনুভূত হওয়া

হাড় ক্ষয় বা অস্টিওপোরোসিস এর টেস্ট বা পরীক্ষা

১। DEXA টেস্ট এর মাধ্যমে অস্টিওপোরোসিস এর উপস্থিতি এবং এর পরিমাণ নির্ণয় করা হয়

২। এক্সরে বোন মিনারেল ডেনসিটি এক্সামিনেশন এর মাধ্যমেও হাড়ের ঘনত্ব নির্ণয় করা হয়ে থাকে


আরো জানুন- শীতকালে নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণ ও লক্ষণসমূহ

হাড় ক্ষয় প্রতিরোধ ব্যবস্থা

হাড় ক্ষয় বা অস্টিওপোরোসিস রোগ দেখা দিলে দরকার সঠিক পরিমাণ খাওয়া-দাওয়া ও বিশ্রাম। দেহের হাড় গঠনের জন্য আমিষ, কোলাজেন, ক্যালসিয়াম, ফসফেট ও ভিটামিন ডি এই রাসায়নিক উপাদান গুলো অত্যন্ত প্রয়োজন হয়। খাদ্য তালিকায় এমন কিছু খাবার রাখা দরকার, যা হাড়ের স্বাস্থ্যের জন্য পুষ্টিকর ক্যালসিয়াম আর ফসফরাস থাকে। একজন মানুষের প্রতিদিন কমপক্ষে ১ হাজার ২০০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম এবং ৪০০ থেকে ৮০০ আই ইউ ভিটামিন ডি গ্রহণ করা উচিত বলে চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

শাকসবজি হিসেবে আপনি পালং শাক বেছে নিতে পারেন হাড় ক্ষয় প্রতিরোধ করার জন্য। প্রতি ১০০ গ্রাম পালং শাক ৯৫ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম এবং ৯৩ মিলিগ্রাম ফসফরাসের ঘাটতি পূরণ করে থাকে। এ ছাড়া সজনে ডাঁটাকে আপনি গ্রহণ করতে পারেন হাড় ক্ষয় রোগের প্রতিরোধক হিসেব। প্রতি ১০০ গ্রাম সজনে ডাঁটায় ৪৪৫ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস পাওয়া যায়। হাড় ক্ষয় রোগ প্রতিরোধের জন্য নিয়মিত এবং পরিমাণমতো ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি জাতীয় খাবার গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া মাছ, মাংস, ডিম ও দুগ্ধ জাত খাবার পরিমাণ মতো খেতে হবে। পাশাপাশি যেসকল ফল মূলে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন পাওয়া যায়, সেই সমস্ত ফলমূল বিশেষ করে খেজুর, আপেল, ড্রাগন ইত্যাদি নিয়ম করে খেতে হবে। সূর্যের আলোতে ভিটামিন ডি পাওয়া যায়। তাই সূর্যের আলো দিয়ে স্নান করতে হবে, যাতে শরীরের প্রায় ৯০ শতাংশ ভিটামিন ডি সূর্যের আলো থেকে গ্রহণ করা যায়। নিয়ম করে প্রতিদিন সূর্যের আলোতে ১৫ থেকে ২০ মিনিট রৌদ্র স্নান করলে হাড়ের স্বাস্থ্য উন্নত হয়। এছাড়া আমাদের শরীরের হাড়ের স্বাস্থ্যকে ভালো রাখার জন্য নিয়ম করে ব্যায়াম করা এবং কিছু স্বাস্থ্য নীতি মেনে চলা দরকার। এজন্য আপনাকে যা করতে হবে-

নিয়মিত ব্যায়াম করুন
প্রতিদিন নিয়ম করে ব্যায়াম করলে হাড়ের শক্তি ও ঘনত্ব বৃদ্ধি পায় এবং শরীরের ভারসাম্য ঠিক রাখা যায়। এতে হাড়ের মধ্যে রক্ত চলাচল বৃদ্ধি করে জয়েন্ট গুলোকে সচল রাখে।

রাত্রে ঘুমের সময় মৃদু আলো
রাত্রে ঘুমের সময় হালকা মৃদু আলো জ্বালিয়ে রাখা ভালো, এতে রাতে অন্ধকারে চলাফেরা ও অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।

ধূমপান ও মদ্যপান পরিহার করুন
ধূমপান ও মদ্যপান পরিহার করতে হবে হাড় ক্ষয় রোগ প্রতিরোধের জন্য। গবেষণায় দেখা গেছে ধূমপান ও মদ্যপানে দেহের হাড়ের ক্ষয় বৃদ্ধি পেয়ে থাকে।

অতিরিক্ত ওজন বহন পরিহার করুন
অতিরিক্ত ওজন বহনের ঝুঁকি এড়িয়ে চলতে হবে, কারণ এতে আপনার শরীরের মেরুদন্ড গুরুতর দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেতে পারে।

রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখুন
হাড়ের স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য ডায়াবেটিস, লিভার, কিডনি রোগ গুলো নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। কারণ এই রোগ গুলো নিয়ন্ত্রণে না থাকলে হাড় ক্ষয়ের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

অতি সাবধানতা
কোন ধরনের দুর্ঘটনা আক্রান্ত হওয়া থেকে বিরত থাকার জন্য আপনাকে অতি সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে, যাতে আপনার শরীরের হাড় ভেঙে যাওয়া থেকে রক্ষা পেতে পারে।

হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা

যখন আমাদের রক্তে ক্যালসিয়ামের অভাব দেখা দেয় তখন দেহেও ক্যালসিয়ামের অভাব দেখা দেয় এবং দেহে ক্যালসিয়ামের অভাবের কারণে হাড়ের অস্থিমজ্জায় ক্যালসিয়াম পৌঁছায় না। এই ক্ষেত্রে ক্যালসিয়ামের অভাবে হাড়ের স্বাস্থ্য দিনে দিনে দুর্বল হতে থাকে। হোমিওপ্যাথিক প্রতিবিধান এমন একটি চিকিৎসা পদ্ধতি; যেখানে প্রতিটি ঔষধকে অতি সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর মাত্রায় প্রয়োগের জন্য প্রস্তুত করা হয় এবং রোগের তীব্রতা অনুযায়ী প্রয়োগ করা হয়। ফলে রোগের অত্যন্ত গভীরে গিয়ে হোমিওপ্যাথিক ঔষধ রোগের সাথে লড়াই করতে পারে এবং রোগশক্তিকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়।

সঠিক ঔষধ নির্বাচন ও চিকিৎসার জন্য অস্টিওপোরোসিস বা হাড় ক্ষয় আক্রান্ত রোগীকে একজন হোমিওপ্যাথিক রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের সাথে সাক্ষাৎ করতে হবে এবং চিকিৎসককে সঠিক ঔষধ নির্বাচনে সহযোগিতা করতে হবে। সাদৃশ্য বিধান মতে- একজন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক "কোন রোগকে নয়, রোগীকে চিকিৎসা করে থাকেন।" অর্থাৎ একজন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক রোগীর ব্যক্তি স্বাতন্ত্র ও সাদৃশ্য উপসর্গের উপর ভিত্তি করে চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকেন। সুতরাং আপনাকে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা গ্রহণ করতে হলে অবশ্যই হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। হোমিওপ্যাথিতে যে সমস্ত ঔষধ হাড় ক্ষয় রোগের জন্য সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয় সেগুলো হল-

অরম মিউর- শরীর শরীরের হাড় বা অস্থি পচন ধরা বা পচে যাওয়া মনে হলে কিংবা শরীরের ভিন্ন ভিন্ন স্থানের অস্থি আক্রান্ত হলে এই ওষুধটি ব্যবহার করা হয়।

ক্যালকেরিয়া ফস- শরীরের হাড় অত্যন্ত নরম মনে হলে এই ঔষধ একজন হোমিওপ্যাথিক ঔষধ প্রয়োগ করে থাকেন।

সিম্পাইটাম- যে সকল ক্ষেত্রে অস্থির বা হাড় খুব সহজে ভেঙে যাওয়ার প্রবণতা থাকে, সেইখানে এই ঔষধ ব্যবহার করা হয়। 

হেক্লা লাভা- অস্টিওপোরোসিস প্রদাহ, ক্যান্সার, উপদংশ ইত্যাদি ক্ষেত্রে এই ওষুধ ব্যবহার করা হয়। 

সাইলিসিয়া- হিপ জয়েন্ট পীড়াগ্রস্ত শিশুদের মেরুদন্ডের বক্রতা দুষ্ট হলে এই ঔষধ প্রয়োগ করা হয়।

এব্রোটেনাম- প্রচুর খাওয়া দাওয়া সত্ত্বেও শরীর এবং শরীরের হাড় শক্ত বোধ না হলে এই ঔষধ প্রয়োগ করা হয়

নেট্রাম মিউর- অতিরিক্ত লবণ খাওয়ার প্রবণতা এবং ব্যথাযুক্ত স্থানে টিপলে আরাম পাওয়া লক্ষণে এই ঔষধ প্রয়োগ করা হয়। 


এছাড়া বায়োকেমিক ঔষধ গুলোর মধ্যে-

ক্যালকেরিয়া ফ্লোর, ক্যালকেরিয়া ফস, নেট্রাম মিউর বায়োকেমিক ঔষধ গুলো প্রয়োগ করা হয়ে থাকে।


উপসংহার

হাড় ক্ষয় রোগ এর প্রবণতা দিনকে দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কথায় বলা হয়-  “প্রতিরোধ রোগের চিকিৎসা থেকে বেশি ভালো।” সুতরাং আমাদেরকে মনে রাখতে হবে হাড় ক্ষয় রোগ যাতে আমাদেরকে আক্রান্ত করতে না পারে, সেজন্য সঠিক ও পরিমাণ মতো খাদ্য গ্রহণ, নিয়মিত শরীর চর্চা ও সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে, যাতে এই রোগ থেকে দূরে থাকা যায়।



সতর্কতাঃ এই প্রবন্ধের লেখাগুলো চিকিৎসকের বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নয় বরং আপনার চিকিৎসার জন্য অবশ্যই একজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ সম্পন্ন এবং রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন