বন্ধ্যাত্ব ও বন্ধ্যাত্ব দূর করার কিছু উপায়

ভূমিকা

বিশ্বব্যাপী লক্ষ লক্ষ দম্পতি বন্ধ্যাত্বের কারণে পিতৃত্ব অর্জনের জন্য মানসিকভাবে দারুণভাবে প্রভাবিত হয়। পিতৃত্ব অর্জন অন্যান্য স্বাস্থ্য জটিলতার মত একটি অন্যতম চ্যালেঞ্জিং বাধা, যাকে বন্ধ্যাত্ব বলা হয়ে থাকে। বন্ধ্যাত্বের অনেকগুলো কারণ থাকতে পারে। আর এই বন্ধ্যাত্ব এর কারণ সম্পর্কে এই প্রবন্ধে আমরা জানার চেষ্টা করব। আমরা বন্ধ্যাত্বের কারণ গুলো অনুসন্ধান করার চেষ্টা করব এবং এটি কিভাবে মোকাবেলা করা যায়, সে সম্পর্কে জানার চেষ্টা করব।

বন্ধ্যাত্ব কি

যে রোগের কারণে সাধারণত স্ত্রীলোকদের সন্তান ধারণ হয় না বা স্ত্রীলোক সন্তান ধারণে অক্ষম হয়, তাকে বন্ধ্যাত্ব বলে। সন্তান ধারণ না হওয়ার অনেকগুলো কারণ থাকতে পারে, যেমন স্ত্রী বা স্বামী যে কোন একজনের দোষ থাকতে পারে, স্ত্রীর অপুষ্ট ডিম্ব এর কারণে সন্তান ধারণ নাও হতে পারে, স্বামী ও স্ত্রীর জটিল কোন যৌন রোগে আক্রান্ত হওয়ার ইতিহাস থাকলে সন্তান ধারণ না হতে পারে, স্ত্রীর জরায়ুর স্থানচুতি হওয়া ইত্যাদি পারিপার্শ্বিক কারণে যখন কোন স্ত্রী লোক সন্তান ধারণে অক্ষম হন, তখন সেই অবস্থা কে বন্ধ্যাত্ব বলা হয়। আবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এর মতে- যখন কোন দম্পতি সন্তান জন্মদানের জন্য এক বছর যাবত একসাথে বসবাস করার পরে সন্তান ধারণে ব্যর্থ হয়, তখন তাকে বলা হয় বন্ধ্যাত্ব বা Infirtility বলে।


বন্ধ্যাত্ব বা ইনফাল্টিলিটি সাধারণত দুই ধরনের। প্রাইমারি বন্ধ্যাত্ব- এটি হলো নিজে নিজে চেষ্টা করার পরে যাদের সন্তান ধারণ কখনো হয়নি তাদেরকেই প্রাইমারি বন্ধত্ব বলা হয়। আবার সেকেন্ডারি বন্ধ্যাত্ব হল- ইতিপূর্বে সন্তান ধারণের চেষ্টা করে যারা সন্তান ধারণ বা গর্ভধারণ করেছেন কিন্তু পরে আর গর্ভধারণ কিছুতেই হয় নাই বা হচ্ছে না, এটি হল সেকেন্ডারি বন্ধু বন্ধ্যাত্ব।

সুতরাং আমরা বলতে পারি যে পারিপার্শ্বিক কারণে স্ত্রী লোকেরা সন্তান ধারণে ব্যর্থ হয় তাকেই সাধারণত বন্ধ্যাত্ব বা Sterility বা Infertility বলা হয়ে থাকে।

Sterility বা Infertility

বন্ধ্যাত্বের কারণসমূহ

সাধারণত যে সকল কারণে বন্ধ্যাত্ব দেখা যায় তার মধ্যে জরায়ুর স্থান চ্যুতি অন্যতম একটি প্রধান কারণ। অবশ্য জরায়ু স্থানচ্যুতি অনেক প্রকারের হয়ে থাকে; এর প্রত্যেকটি যে সন্তান ধারণ বাধা দেয় তা কিন্তু নয়। এছাড়া জরায়ুর মধ্যে টিউমার, বাধক, শ্বেতপ্রদর বা লিউকরিয়া, জরায়ু মুখের সংকোচন ইত্যাদি ক্ষেত্রবিশেষে বন্ধ্যাত্বের অন্যতম কারণ হয়ে দেখা দেয়। আবার যে সকল স্ত্রীলোক অতিরিক্ত মোটা বা স্থূলতা হয় তাদের অনেকেই বন্ধ্যাত্ব হতে দেখা যায়। সুতরাং অতিরিক্ত মেদ বা চর্বি এর বড় একটি কারণ বলে ধরা হয়।

এছাড়া পারিপার্শ্বিক অন্যান্য কারণে বন্ধ্যাত্বের সৃষ্টি হতে পারে এবং সেগুলো থেকে কিভাবে পরিত্রাণ পাওয়া যায় সেই সম্পর্কে নিচে চলুন জানার চেষ্টা করি-

হরমোনের ভারসাম্যহীনতা
বন্ধ্যাত্বের অন্যতম একটি প্রধান কারণ হলো হরমোনের ভারসাম্যহীনতা যা সফল গর্ভধারণের জন্য প্রয়োজনীয় প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। এটি নির্দিষ্ট প্রয়োজনীয় হরমোনের অতিরিক্ত উৎপাদন অথবা কম উৎপাদনই হোক না কেন, এই ভারসাম্যহীনতা গুলো একটি বন্ধ্যাত্বের উল্লেখযোগ্য কারণ তৈরি করে থাকে। এই ধরনের সমস্যা সমাধানের জন্য হরমোন থেরাপি এবং সহায়ক প্রজনন প্রযুক্তি এর মতো আধুনিক চিকিৎসার মাধ্যমে বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসা বর্তমানে চিকিৎসকরা দিয়ে যাচ্ছেন। তবে স্বতন্ত্র পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করে সবচেয়ে সুবিধার জনক উপযুক্ত পদ্ধতি গ্রহণের জন্য একজন হরমোন বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বয়স সম্পর্কিত কারণ
বয়স বেশি হয়ে যাওয়া, উর্বরতা শক্তি নির্ণয়ের একটি অনস্বীকার্য কারণ। একজন মহিলার ডিম্বানুর সংখ্যা তার বয়স বাড়ার সাথে সাথে কম হয়ে যাওয়া বা হ্রাস পাওয়া, আবার পুরুষদের শুক্রাণুর গুণগত মান হ্রাস পাওয়া এইটা গোপন করার মতো কোনো বিষয় নয় । এই সকল সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য দম্পতিরা সাধারণত আইভিএফ বা ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন (In Vitro Fertilization-IVM) বা ডিম ফ্রিজিং পদ্ধতি গ্রহণ করতে পারে। এছাড়া পিতৃত্বের দায়ভার এর বিকল্প হিসেবে সন্তান দত্তক গ্রহণ এর মত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।

প্রজনন অঙ্গের কাঠামোগত অস্বাভাবিকতা
কখনো কখনো প্রজনন অঙ্গের আকৃতিগত বা গঠনগত অস্বাভাবিকতার কারণে বন্ধ্যাত্ব হতে পারে। অ্যান্ডোমেট্রিওসিস, জরায়ু ফাইব্রয়েড বা অবরুদ্ধ ফেলোপিয়ান টিউব এর মত অবস্থা গর্ভধারণকে বাধাগ্রস্থ করতে পারে। এই সকল ক্ষেত্রে ল্যাপারোস্কপিক সার্জারির মাধ্যমে এই সকল সমস্যাগুলোকে সংশোধন করে সন্তান ধারণের সম্ভাবনাকে অনুকূল করা হয়ে থাকে।

জীবনযাপন পরিবর্তন
আধুনিক জীবনযাপনের কারণে অসাবধানতাবশত বন্ধ্যাত্বের অন্যতম কারণ হতে পারে। অতিরিক্ত মানসিক স্ট্রেস, অলসভাবে জীবন যাপন, ধূমপান করা, অত্যাধিক অ্যালকোহল গ্রহণ করা, শারীরিক স্থূলতা ইত্যাদি কতিপয় জীবন ধারণ প্রক্রিয়ার কারণে বন্ধ্যাত্বের কারণ সৃষ্টি হতে পারে। এ কারণে স্বাস্থ্যকর জীবন যাপন গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই জন্য নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম ও মানসিক চাপ দূর করার কৌশলগুলো গ্রহণ করতে হবে এবং গর্ভধারণের লক্ষ্যে দম্পতিদের শারীরিক সুস্থতাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।


এক নজরে নারী ও পুরুষের বন্ধুত্বের কারণ

নারী বন্ধুত্বের কারণ
  • জন্মগত ত্রুটি যেমন জরায়ু না থাকা, ডিম্বাশয় ছোট থাকা , জরায়ুর অপরিপক্কতা, জন্মগতভাবে ডিম্বানু না থাকা বা কম থাকা বা ডিম্বাশয় ছোট থাকা
  • নারীদের প্রতি মাসে যে ডিম্বানু, ডিম্বাশয় বা অভারি থেকে নিঃসরণ হওয়ার কথা তা সঠিকভাবে নিঃসরণে বাধাগ্রস্ত হওয়া
  • খাদ্য অভ্যাস, মানসিক চাপ, বয়স, পরিবেশ, টিউমার, ক্যান্সার, চকোলেট সিস্ট ইত্যাদি কারণে ডিম্বাণুর সংখ্যা কমে যেতে পারে
  • হরমোন জনিত সমস্যা যেমন থাইরয়েড হরমোন, প্রোলেকটিন হরমোন ইত্যাদি হরমোনের কারণে বন্ধ্যাত্ব হতে পারে। এছাড়া বিভিন্ন যৌনবাহিত রোগের কারণে নারীরা বন্ধ্যাত্বের শিকার হয়ে থাকেন

পুরুষ বন্ধ্যাত্বের কারণ
  • পুরুষের বীর্যে এজোস্পার্মিয়া বা শুক্রানুর অনুপস্থিতি
  • প্রজনন অঙ্গে আঘাত লাগা, অস্ত্রোপচার, ধূমপান, ডায়াবেটিস, ছোটবেলায় মাম্পস রোগ হওয়া, যৌনবাহিত রোগে আক্রান্ত হওয়া, জনন অঙ্গে যক্ষা ইত্যাদি কারণে পুরুষ বন্ধ্যাত্বের শিকার হয়ে থাকেন
  • পুরুষদের শরীরে প্রধান হরমোন টেস্টোস্টেরন এর মাত্রা সঠিক মাত্রায় না থাকা। এছাড়া অলিগোস্পার্মিয়া বা শুক্রাণু কমে যাওয়া, অচল বা ত্রুটিযুক্ত শুক্রাণুর আধিক্য

বন্ধ্যাত্বের হোমিওপ্যাথিক প্রতিকার

যদিও বন্ধ্যাত্ব একটি হতাশা জনক শারীরিক সমস্যা, তবুও বন্ধ্যাত্বের প্রতিকারের জন্য নারী পুরুষ উভয়কেই সচেতন থাকতে হবে, বিশেষ করে খাদ্য অভ্যাস পরিবর্তন থেকে শুরু করে কিছু খাদ্য গ্রহণ বন্ধ করা পর্যন্ত অভ্যাসগুলি পরিবর্তন করতে হবে। যেমন শর্করা জাতীয় ও ফাস্টফুড খাওয়া বন্ধ করতে হবে, শাকসবজি ফলমূল ও প্রোটিন জাতীয় খাবার বেশি করে গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া স্বামী-স্ত্রী উভয়কেই এই সমস্যা প্রতিকারের জন্য সচেষ্ট থাকতে হবে। এক তরফা স্বামী অথবা সমাজের অন্য কেউ যদি স্ত্রীর উপর দায়ভার চাপানোর চেষ্টা করেন, তাহলে তার স্ত্রীর মানসিক চাপ বৃদ্ধি পেতে পারে, যা সন্তান ধারণের একটি বড় বাধা। প্রাকৃতিক কারণ ছাড়া অন্য কোন কারণ বা সন্তান ধারনের কারণ হয়ে থাকলে, তার চিকিৎসা স্বামী এবং স্ত্রী উভয়কেই একজন হোমিওপ্যাথিক অভিজ্ঞ চিকিৎসকের সহযোগিতায় গ্রহণ করতে হবে। হোমিওপ্যাথিতে বিশেষ কিছু বন্ধ্যাত্বের ঔষধ আছে; যা লক্ষণ অনুযায়ী প্রয়োগ করা হলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভালো ফলাফল পাওয়া সম্ভব। একজন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক যে সকল ঔষধ গুলি লক্ষণ অনুযায়ীবন্ধ্যাত্ব রোগীদের প্রয়োগ করে থাকেন সেগুলো হল- কোনিয়াম, অরাম মেট, এগনাস কাস্ট, আয়োডিন, নেট্রাম মিউর ইত্যাদি।

উপসংহার

পিতৃত্ব অর্জনে বন্ধ্যত্ব যদিও একটি জটিল ও হতাশা জনক বিষয় বা সমস্যা, এই সমস্যা বা বাধা চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করার মত সচেতন এবং মানসিকতা তৈরি করা অপরিহার্য। এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য দম্পতিকে বন্ধ্যাত্বের কারণ সম্পর্কে কার্যকরী সমাধান খোঁজার জন্য একজন বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হওয়া একান্ত অপরিহার্য। কারণ আধুনিক চিকিৎসা উন্নয়নের কারণে এই সকল সুবিধা গ্রহণ করে স্বাস্থ্যকর জীবনধারা অবলম্বন করে বিকল্প পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন