অবশেষে ৭ নভেম্বর মঙ্গলবার ২০২৩, পোশাক শিল্প খাতে কর্মরত শ্রমিকদের নতুন মজুরি কাঠামো নির্ধারণ করা হয়। নতুন মজুরি কাঠামো অনুযায়ী এখন থেকে তৈরি পোশাক শিল্প খাতে কোন শ্রমিক নতুন ভাবে নিয়োগ প্রাপ্ত হলে, তাকে কমপক্ষে ১২ হাজার ৫০০ টাকা মজুরি দিতে হবে। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের অসহনীয় মূল্য বৃদ্ধির কারণে পোশাক শিল্পের শ্রমিক ও শ্রমিক প্রতিনিধিরা এই নতুন কাঠামো মানতে রাজি নয়। তাদের দাবি ন্যূনতম মজুরি কমপক্ষে ২০ হাজার ৩৯৩ টাকা করতে হবে। এছাড়া মজুরি বাড়ানোর সাথে সাথে পেনশন, রেশনিং, গ্র্যাচুইটি এবং গ্রেড প্রতি ১০% করে মজুরি বৃদ্ধি করার দাবি শ্রমিক প্রতিনিধিদের। কিন্তু এই সকল দাবির বেশির ভাগই উপেক্ষা করা হয়েছে বলে দাবি করেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন- সরকার মালিকপক্ষের প্রস্তাবটি সমর্থন করেছে। তিনি আরোও বলেন- নতুন যে মজুরি কাঠামো ঘোষণা করা হয়েছে, তা শ্রমিক পক্ষের প্রস্তাবনার অর্ধেক। আর একটি বিষয় হল, গ্রেড ৭টির পরিবর্তে ৫টি গ্রেডে উন্নিত করার ফলে সার্বিকভাবে শ্রমিকদের মজুরি ব্যয় কোন কোন ক্ষেত্রে মজুরি প্রাপ্যতা আরো কমে যাবে। কারণ গ্রেড সমন্বয় বিষয়টি এখনো স্পষ্ট নয়, কোন গ্রেড বাদ দেওয়া হয়েছে এবং কোথায় কি সংযোজন করা হয়েছে।
চলতি বছরের এপ্রিলে বিজিএমইএ চেয়ারম্যান ও স্বতন্ত্র প্রতিনিধি, কারখানা মালিকপক্ষ, শ্রমিক প্রতিনিধি ও শ্রমিক পক্ষ, বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশন এবং সরকারের একজন প্রতিনিধি নিয়ে সপ্তম নিম্নতম মজুরি বোর্ড গঠন করা হয়। এই সপ্তম নিম্নতম মজুরি বোর্ড গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত নতুন মজুরি কাঠামো নির্ধারণের জন্য মোট ৬টি সভা করে। নতুন মজুরি বোর্ডের চতুর্থ সভায় শ্রমিক পক্ষ এবং মালিকপক্ষ ন্যূনতম নতুন মজুরি নিয়ে দর কোষাকষি করে। শ্রমিকপক্ষ ২০ হাজার ৩৯৩ টাকা দাবি করলে, মালিকপক্ষ ১০হাজার ৪০০ টাকা ন্যূনতম মজুরি প্রদানের প্রস্তাব উত্থাপন করে। পরবর্তীতে মজুরি বোর্ডের সমালোচনা ও শ্রমিক আন্দোলনের মুখে মালিকপক্ষ তাদের দেওয়া প্রস্তাব প্রত্যাহার করে এবং গতকালের ষষ্ঠ সভায় ১২ হাজার ৫০০ টাকা মজুরি প্রদানের প্রস্তাব ঘোষণা করে। শ্রম মন্ত্রণালয় সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে শ্রম প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি ১২ হাজার ৫০০ টাকা ঘোষণা করেন।
শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি ১২ হাজার ৫০০ টাকা ঘোষণা করা হলে, অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন এতে ৫৬.২৫ শতাংশ মূল মজুরি বৃদ্ধি করা হয়েছে। কিন্তু সিপিডি এর গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম এটি মানতে রাজি নন। তিনি বলেন- গত মজুরি কাঠামোতে সপ্তম গ্রেডের একজন ওয়ার্কার ৯ হাজার ৯০০টাকা মজুরি পেতেন, সেই বিবেচনায় তার বেতন কিন্তু ৫৬.২৫% বৃদ্ধি পায় নাই; বৃদ্ধি পেয়েছে ২৬ শতাংশ। তার মতে শ্রমিকদের বেতন হওয়া উচিত ১৭ হাজার ৫০০ টাকা। যেখানে কম্বোডিয়ায় একজন শ্রমিকের জন্য ব্যয় করা হয় ২০০ ডলার, ভিয়েতনামে ব্যয় করা হয় ১৭৩ ডলার। এছাড়া মালিকপক্ষকে প্রতিযোগী দেশগুলোর সাথে সমন্বয় করে মজুরি কাঠামো নির্ধারণের উদ্বেগ গ্রহণ করতে হবে বলে তিনি মনে করেন।
পোষাক খাতে শ্রমিকদের জন্য ৭টি গ্রেডের পরিবর্তে ৫টি গ্রেডে উন্নীত করে মজুরি কাঠামো চূড়ান্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে দক্ষতার দিক থেকে সর্বশেষের স্তর বা শুরুর স্তরের শ্রমিকদের জন্য এই মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন- যে মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে, তা দিয়ে শ্রমিক পরিবারের চাহিদা মেটানো কষ্ট হবে। যদিও সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে এই মজুরি সমন্বয়ের সুযোগ আছে বলে মনে করেন তারা। মালিকপক্ষ এবং মালিকপক্ষদের সংগঠন বিজিএমইএ- এর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে মজুরি কাঠামোটি মালিকদের জন্য বাড়তি কিছু হলেও তারা পোশাক শিল্পের স্বার্থে আগামী ডিসেম্বর মাস থেকে এটি বাস্তবায়ন করবেন।
ঘোষিত নতুন মজুরি কাঠামোতে শ্রমিক পক্ষের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্যমান ৫টি গ্রেডে কোন পর্যায়ে কি সুযোগ সুবিধা আছে, তার খসড়া প্রজ্ঞাপন দ্রুত প্রকাশ করা হবে, যা সকল পক্ষের মতামত ও আপত্তির শুনানি শেষে চূড়ান্ত করা হবে। চূড়ান্ত প্রজ্ঞাপনটি বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য কার্যকর থাকবে।
এর আগে ২০১৩ সালে ও সর্বশেষ.২০১৮ সালে মজুরি কাঠামো ঘোষণা করা হয়। ২০১৩ সালের মজুরি কাঠামো অনুযায়ী এন্ট্রি লেভেলে একজন শ্রমিক নিম্নতম ৫ হাজার ৩০০ টাকা মজুরি পেতেন। আবার ২০১৮ সালে শুরুতেই একজন শ্রমিক নিম্নতম ৮ হাজার ৮৭৫ টাকা মজুরী পেতেন।
উপসংহারে বলা যায়- বাংলাদেশে সম্প্রতি প্রণীত নিম্নতম মজুরি কাঠামো ২০২৩ শ্রমিকদের জীবন যাত্রার মান উন্নয়নে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। যথাযথ মজুরি কাঠামো শুধুমাত্র শ্রমিক ও তাদের পরিবারকে উপকৃত করবেনা বরং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতা আনয়নে বিশেষ অবদান রাখবে। একটি বিকশিত অর্থনীতিতে এর প্রাসঙ্গিকতা নিশ্চিত করার জন্য নিম্নতম মজুরি ক্রমাগত মূল্যায়ন এবং সংশোধন করা অত্যন্ত প্রয়োজন। আসুন আমরা এমন একটি সমাজের জন্য সংগ্রাম করি, যেখানে শ্রমিকরা তাদের অবদানের জন্য মূল্যবান এবং পর্যাপ্ত পুরস্কৃত হয়।