ঢেঁকি শাকের পুষ্টিগুণ ও ৩টি রেসিপি

ভূমিকা

কেউ বলেন ঢেঁকি শাক আবার কেউবা বলেন পালই শাক। অনেকেই আবার এই শাককে বউ শাক বলে থাকেন। আসলে এর বৈজ্ঞানিক নাম হল Diplazium esculentum এবং এটি Athyriaceae প্রজাতি পরিবারের একটি উদ্ভিদ। এই শাক দেখতে অনেকটা পালং শাকের মতো তবে এর পাতা পালং শাকের পাতা থেকে একটু বড় এবং ঘন টাইপের। ঢেঁকি শাক, বাবু শাক কিংবা ঢেকিয়া শাক আঞ্চলিক নাম যাই হোক না কেন এই শাকের ডাঁটায় ডাঁটায় রয়েছে ভরপুর পুষ্টিগুণ। এই স্বাদ সাধারণত বসন্ত ও শরৎকালে বেশি পাওয়া যায়। আজকের আর্টিকেলে ঢেঁকি শাকের গুনাগুন এবং কয়েকটি রেসিপি নিয়ে আলোচনা করব।

ঢেঁকি শাকের পুষ্টিগুণ ও ৩টি রেসিপি

বিভিন্ন ধরনের শাক ও এর ইংরেজি নাম

আমাদের দেশে সারা বছর ধরে প্রায় ১৫ ধরনের শাক পাওয়া যায়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে-

  • পালং শাক- Spinach
  • কলমি শাক-Water amarnath
  • মুলা শাক-Radish Leaves
  • সরষে শাক-Mustard Leaf
  • লাল শাক-Red amarnath
  • পুঁইশাক-Malabar spinach
  • পুদিনা শাক-Mint leaf
  • মেথি শাক-Fenugreek
  • ডাঁটা শাক-Stem amarnath
  • কচু শাক-Taro stem/ Arum Leaves
  • ঢেঁকি শাক-Edible fern
  • লাউ শাক-Pumpkin leaves
  • ধনেপাতা-Coriander

ঢেঁকি শাকের পুষ্টিগুণ

আমাদের দেশে বাহারি রকমের শাক সবজির মধ্যে ঢেঁকি শাক গ্রাম বাংলার অতি পরিচিত ও অত্যন্ত প্রিয় একটি শাক। এই শাক নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে ছায়াযুক্ত স্যাঁতসাঁতে এলাকায় এবং বনে জঙ্গলে বেশি দেখা যায়। থাইল্যান্ড-এ এই শাকের ভীষণ জনপ্রিয়তা আছে। আমাদের বাংলাদেশেও উত্তরবঙ্গের জনগণ এই শাক খুব ভালোবাসেন।

ঢেঁকি শাকে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার সমৃদ্ধ পুষ্টিগুণ যা শারীরিক ওজন কমানোর জন্য এবং হৃদপিন্ডের রোগ প্রতিরোধক ব্যবস্থা হিসেবে অনেকেই এটিকে গ্রহণ করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এছাড়া দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধির জন্য, পরিপাকতন্ত্র সমস্যা, ছোঁয়াচে কাশজনিত ঠান্ডা সমস্যা, ডায়াবেটিসের সমস্যা দূর করার জন্য ঢেঁকি শাকে রয়েছে অনন্য পুষ্টিগুণ। চলুন জেনে নেই ঢেঁকি শাকের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে-

ভিটামিন এ- ঢেঁকি শাকে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ, যার কারণে দৃষ্টিশক্তি ভালো থাকে এবং এটি খেলে দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধি হয়। 

ভিটামিন সি- ঢেঁকি শাকে পাওয়া যায় প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন সি। আর এই ভিটামিন সি শরীরের রোগ প্রতিরোধক শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে থাকে।

ক্যালসিয়াম- ঢেঁকি শাকে প্রচুর পরিমানে ক্যালসিয়াম পাওয়া যায়। এই ক্যালসিয়াম আমাদের শরীরের দাঁত ও হাড় সুরক্ষার জন্য সহযোগিতা করে। এছাড়া এই শাক খেলে অস্টিওপোরেসিস ও ক্যালসিয়াম এর অভাবজনিত রোগের ঝুঁকি কমায়।

আয়রন- ঢেঁকি শাকে রয়েছে আইরন। আয়রন শরীরের রক্তস্বল্পতা দূর করতে সাহায্য করে। 

পটাশিয়াম- পটাশিয়াম রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে বিশেষভাবে সাহায্য করে, ফলে উচ্চ রক্তচাপ কিংবা নিম্ন রক্তচাপ জনিত কোন সমস্যা দূর করতে পটাশিয়াম এর অভাব ঢেঁকি  শাকের মাধ্যমে পূরণ হতে পারে। 

ফাইবার- একই সাকে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে উচ্চ ফাইবার, যা হজমে সাহায্য করে এবং শরীরের ওজন কমাতে সাহায্য করে।
 

ঢেঁকি শাক কিভাবে খাওয়া হয়

ঢেঁকি শাক খাওয়ার বিভিন্ন রকম উপায় রয়েছে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই শাক ভাজি করে খাওয়া হয়। এছাড়া ঢেঁকি শাকের ঝোল, ডাল দিয়ে ঢেঁকি শাক রান্না, সালাদের সাথে ঢেঁকি শাক খাওয়া হয়। তবে খাওয়ার উপযুক্ত ঢেঁকি শাক ক্রয় করার সময় অবশ্যই সবুজ রঙের ঢেঁকি শাক এবং টাটকা শাক কিনতে হবে। পাতায় কোন দাগ বা ক্ষত যুক্ত শাক না কেনাই ভালো।

ঢেঁকি শাকের ৩টি রেসিপি

ঢেঁকি শাকের ভাজি রান্না
ঢেঁকি শাকের ভাজি রান্না করার জন্য যে সকল উপাদান গুলো প্রয়োজন হবে সেগুলো হল-

  • কুচি করা ঢেঁকি শাক- ২ আটি
  • নারকেল কোড়া- ২ টেবিল চামচ
  • তেল- ২ চা চামচ
  • লবণ- ১/২ চা চামচ
  • হলুদ গুঁড়া- ১/২ চা চামচ
  • কালোজিরা- ১/২ চা চামচ
  • পেঁয়াজ কুচি- ২ চার চামচ
  • রসুন কুচি- ১ চা চামচ
  • চেরালঙ্কা- ৪টি
  • শুকনো মরিচ- ৩টি
 
প্রণালী
প্রথমে ঢেঁকি শাক ভালো করে ধুয়ে কুচিয়ে নিতে হবে। এরপর কড়াই বা ফ্রাইং প্যানে গোটা শুকনো লঙ্কাগুলো ভালো করে ভেজে নিন। শুকনো মরিচ হালকা ভাজা হয়ে গেলে তার সাথে পেঁয়াজ কুচি রসুন কুচি চেরা কাঁচা লঙ্কা এবং অন্যান্য উপকরণগুলো দিয়ে নাড়তে থাকুন। কড়াই এর উপকরণগুলো হালকা ভাজা হয়ে গেলে তাতে হলুদ গুঁড়ো, লবণ দিয়ে ভালো করে নেড়ে নিন। এরপর ঢেঁকি শাক গুলো কড়াই এর মধ্যে দিয়ে ভালো করে নাড়তে থাকুন। কড়াইয়ে থাকা শাকগুলো ভাজা ভাজা হয়ে গেলে নামিয়ে নিন। এবার ঠান্ডা করে গরম ভাতের সঙ্গে পরিবেশন করুন ঢেঁকি শাকের ভাজি।


ঢেঁকি শাক দিয়ে মসুর ডাল রান্না
যে সকল উপাদান প্রয়োজন
  • মসুর ডাল- ৫০ গ্রাম
  • ঢেঁকি শাক- ১আটি
  • রসুন কোয়া- ৪টি
  • পেঁয়াজ কুচি- ১ টেবিল চামচ
  • পাঁচফোড়ন- ১/২ চা চামচ
  • সর্ষের তেল- ২ চা চামচ
  • শুকনো লঙ্কা- ২টি
  • লবণ- পরিমাণ মতো

প্রণালী
ঢেঁকি শাক ভালো করে ধুয়ে কেটে দিতে হবে। এরপর ডাল সিদ্ধ করে নিতে হবে। অন্য একটি কড়াই চুলায় চাপিয়ে দিয়ে তেল গরম হওয়ার পর শুকনো লঙ্কা ও পাঁচফোড়ন দিয়ে দিতে হবে এবং পেঁয়াজ, রসুন ও অন্যান্য উপকরণ দিয়ে হালকা করে ভেজে নিতে হবে। এবার কড়াই এর মধ্যে ঢেঁকি শাক দিয়ে দিতে হবে এবং ভালোভাবে নাড়তে হবে। দুই মিনিট ভাজার পর সেদ্ধ করা ডাল কড়াইয়ে দিয়ে দিতে হবে এবং পরিমাণ মতো পানি দিয়ে নেড়ে দিতে হবে। ডাল ফুটে উঠার পর দুই মিনিট জাল দিয়ে নামিয়ে ঠান্ডা করে পরিবেশন করুন ঢেঁকি শাকের সাথে মসুর ডাল।

ঢেঁকি শাক দিয়ে আলু ভাজা

, যে সকল উপাদান প্রয়োজন
  • ঢেঁকি শাক- ২ আঁটি কুচি করে কাটা
  • আলু- ২টা কুচি করে কাটা
  • কাঁচালঙ্কা- ৪টা
  • শুকনো লঙ্কা গুড়া- ১/২ চা চামচ
  • পেঁয়াজ কুচি- ১/২ টেবিল চামচ
  • কালোজিরা- ১/২ চা চামচ
  • পাঁচ ফোড়ন-১/২ চা চামচ
  • হলুদ গুঁড়া- ১/২ চা চামচ
  • চিনি- ১ চা চামচ
  • লবণ- স্বাদ মতো 

প্রণালী
প্রথমে শাক ও আলু ভালো করে ধুয়ে নিন এবং কুচি করে কেটে নিন। এরপর একটি কড়াইয়ে তেল দিয়ে লঙ্কা, কালো জিরে, পেঁয়াজ কুচি, পাঁচফোড়ন ও অন্যান্য উপকরণ দিয়ে দিন এবং আগে থেকে কেটে রাখা আলু ও ঢেঁকি শাক দিয়ে হালকা করে নাড়তে থাকুন। এরপর পরিমাণমতো জল দিয়ে ঢেকে দিন। শাক ও আলুগুলো ভালোভাবে সেদ্ধ করে নিতে হবে। ঢেঁকি শাক ও আলু ভালোভাবে সেদ্ধ হয়ে গেলে নামিয়ে নিন এবং পরিবেশন করুন।

উপসংহার

 ঢেঁকি শাক দাঁতের ক্ষত ও ক্যাভিটি দূর করতে ফুসফুস ও ত্বকের ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে পুরনো ঠান্ডা কাশি দূর করতে ঘা ক্ষত বা শরীরের কাটাছেঁড়া সারিয়ে তুলতে লিভার ইনফেকশন দূর করতে বিভিন্ন ধরনের ব্যথা সারাতে কার্যকরী ভূমিকা রাখে। এতসব গুন থাকার পরেও ঢেঁকি শাক দিনকে দিন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। নতুন প্রজন্মের তরুণরা হয়তো অনেকেই আছেন যারা ঢেঁকি শাক চেনেন না। আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধের জন্য এবং নতুন প্রজন্মের কাছে এই ঢেঁকি শাক যাতে হারিয়ে না যায় এইজন্য সরকারি উদ্যোগে এবং বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ঢেঁকি-শাকের চাষ করা একান্ত জরুরি বলে পুস্টিবিদ গন মনে করেন। 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন