বিভিন্ন ধর্মে দীপাবলির কাহিনী

দীপাবলি হলো সনাতন ধর্মাবলম্বী হিন্দুদের একটি অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব। হিন্দু পঞ্জিকা মতে কার্তিক মাসে অনুষ্ঠিত হয় এই দীপাবলি, যা গ্রেগোরীয় বর্ষ পঞ্জিকার অক্টোবর বা নভেম্বর মাসের মধ্যে পড়ে। অন্যান্য ভারতীয় ধর্মাবলম্বীরাও এটি উদযাপন করে থাকেন। এটি আধ্যাত্মিক অন্ধকারের উপর আলোর বিজয়' মন্দের উপর ভালোর প্রভাব এবং অজ্ঞতার ওপর জ্ঞানের প্রতীক; হিসেবে পালন করা হয়ে থাকে। এই দিন সব সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বাড়িতে নানা ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। তবে জৈন-শিখ ধর্মাবলম্বীরাও এই সময়ে একই ধরনের উৎসব পালন করে থাকেন। এছাড়া আদিবাসী বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যেও এই দীপাবলি পালনের প্রচলন লক্ষ্য করা যায়। দীপাবলি বাংলাদেশ সহ ভারত নেপাল, শ্রীলংকা, মিয়ানমার, মরিশাস, সুরিনাম, ত্রিনিদাদ সহ পৃথিবীর আরও কয়েকটি দেশে সরকারি ছুটি দেওয়া হয়ে থাকে। বাংলাদেশেও এই দিনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছুটি দেওয়া হয়।

দীপাবলির কাহিনী

বিভিন্ন ধর্মে দীপাবলির কাহিনী 

বিভিন্ন ধর্মে দীপাবলীর বিভিন্ন কাহিনী উল্লেখ করা হলেও সনাতন ধর্মাবলম্বী হিন্দুদের কাছে দীপাবলীর সবচেয়ে জনপ্রিয় কাহিনী হল রামায়ণের কাহিনী।

রামায়ণে বর্ণিত কাহিনী

ত্রেতা যুগে রাবণ নামে এক রাক্ষসরাজ অসুর সীতাকে অপহরণ করে লংকা পুরীতে নিয়ে যায়। রাম হলেন সীতার স্বামী, যিনি লঙ্কা পুরীতে রাবণকে বধ করে সীতাকে উদ্ধার করেন। অতঃপর রাম, স্ত্রী সীতা এবং ছোট ভাই লক্ষণসহ দীপাবলীর দিন অযোধ্যায় ফিরে আসেন। তাদেরকে স্বাগত জানাতে অযোধ্যা বাসীরা ঘরে ঘরে আলো জ্বালিয়ে উৎসব পালন করেন; যা দীপাবলি উৎসব নামে পরিচিতি লাভ করে।

জৈন ধর্মে দীপাবলি

জৈন ধর্মে দীপাবলীর কাহিনী এভাবেই লিপিবদ্ধ হয়েছে- মহাবীর দীপাবলীর দিন নির্বাণ লাভ করেন। মহাবীর হলেন একজন জৈন ধর্মের প্রবর্তক, যিনি দীর্ঘ ১২ বছরের কঠোর তপস্যার পর দীপাবলির দিন মোক্ষ লাভ করেন।

শিখ ধর্মে দীপাবলি

শিখদের ষষ্ঠ গুরু হরগোবিন্দ সিংহ গোয়ালিয়র দুর্গ থেকে দীপাবলির দিন মুক্তি লাভ করেন। হরগোবিন্দ সিংহকে সম্রাট জাহাঙ্গীর বন্দি করে গোয়ালিয়র দুর্গে বন্দী করে রাখেন। হরগোবিন্দ সিংহের অনুসারীরা দীপাবলীর দিন গোয়ালিয়র দুর্গ আক্রমণ করে এবং তাঁকে মুক্ত করে নিয়ে আসেন। সেই থেকে শিখ ধর্মেও দীপাবলি উৎসব পালন করা হয়ে থাকে।

আদিবাসীদের দীপাবলি উৎসব

সাঁওতালদের দীপাবলি

নৃ-তাত্তিক জনগোষ্ঠী আদিবাসী সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মধ্যে দিপাবলি পালন করার প্রচলন আছে। এই দিনে তারা পূর্বপুরুষদের স্মরণ করেন, যাতে তাদের পূর্বপুরুষেরা তাদেরকে আশীর্বাদ করে। এই দিনে সাঁওতলেরা দীপাবলীর উৎসবে তাদের নিজেদের ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, দোকানপাট আলোকসজ্জায় সজ্জিত করেন। দীপাবলীর রাতে তারা পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করেন।

ওরাওঁদের দীপাবলি

ওরাওঁরা দীপাবলিকে "শহরাই' উৎসব নামে অবিহিত করেন। প্রতিবছর কার্ত্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের অমাবস্যা তিথিতে ওরাওঁরা এই দিন পালন করে থাকেন। এই দিনে তারা দিনের শুরুতেই চাষাবাদের যন্ত্রপাতি, ঘরবাড়ির, আসবাবপত্র ইত্যাদি ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করেন এবং সন্ধ্যায় তাদের ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, দোকানপাট ফসলের জমি প্রত্যেকটি জায়গায় আলোকসজ্জায় সজ্জিত করেন। ওরাওঁদের দীপাবলীর আর একটি অন্যতম রিচুয়াল হল তারা তাদের বাড়িতে গৃহপালিত পশুর বিশেষ সেবা শুশ্রূষা করা। এই দিন বাড়ির গবাদি পশু বিশেষ করে গরু এবং মহিষ থেকে থাকলে তাদেরকে স্নান করানো, তাদের শরীরে আলপনা দেওয়া এবং শিং এ তেল ও সিঁদুর মাখিয়ে দেওয়া, গবাদি পশুগুলোকে মাসকলাই ডালের সাথে ভাত রান্না করে খাওয়ানো ইত্যাদি করে থাকেন এবং তাদেরকে নিয়ে উৎসবে মেতে উঠেন। এ সময় তারা গান গেয়ে থাকেন-

আরে ধীরে চালবে ধীরে বারদা পাও ফান্দিয়া রে
ইহে হিকেউ তরহ অচিন্তকের ঘরা হে
আরে কোন শিং-এ লেবে বারদা তেল আর সিন্দুরা রে
ডাইনে শিং-এ লেবে বারদা মেরুয়ারি হে
আজ তো তোর হিকে পারাবোও রে ----


অর্থাৎ হে আমার দেবতুল্য গবাদি পশু, তুমি তাড়াহুড়া করো না, এইটা তোমার মনিবের বাড়ি। তোমার কারণে এবং তোমার আশীর্বাদে আমার পরিবার আজ সুখী। আজ তোমার বিশেষ উৎসবের দিন, তুমি বলো কোন সিং এ তোমাকে তেল এবং সিঁদুর মাখিয়ে দেব।

ওরাওঁদের কাছে দীপাবলি বা শহরাই উৎসব হল অন্ধকারের উপর আলোর বিজয়ের উৎসব। এই দিন তারা পূর্বপুরুষদের স্মরণ করেন এবং তাদের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করেন। দীপাবলির দিন গৃহপালিত পশুদের বিশেষ দিন হিসেবেও পালন করে থাকেন নৃতাত্ত্বিক আদিবাসী ওরাওঁ জনগোষ্ঠী।

দীপাবলীর রীতিনীতি

দীপাবলিতে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, দোকানপাট, মন্দির সবকিছু আলোক শয্যায় সজ্জিত করা হয়ে থাকে। সনাতন ধর্মাবলম্বী হিন্দুরা অনেকেই এই দিন লক্ষ্মী ও গণেশ দেবের পূজা করে থাকেন। লক্ষ্মী দেবী ধন সম্পদের দেবী এবং গণেশ দেব জ্ঞান ও বিঘ্নবিনাশের দেবতা। এই দিনে মিষ্টি খাওয়া নতুন পোশাক পরিধান করা আত্মীয়-স্বজন বন্ধুবান্ধব সকলের সাথে সাক্ষাৎ করা ইত্যাদি প্রচলন লক্ষ্য করা যায়।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন