বাঁধাকপি খাওয়ার উপকারিতা

ভূমিকা

শীতের সবজি বলতে যে সকল সবজির কথা মনে পড়ে সেগুলোর মধ্যে আলু, মুলা, গাজর, টমেটো, ফুলকপি ও বাঁধাকপি অন্যতম সবজি। আজকের এই নিবন্ধে শীতকালীন সবজির একটি অন্যতম সবজি বাঁধাকপি নিয়ে আলোচনা করব, যার পুষ্টিগুণ অত্যন্ত সমৃদ্ধ। বাঁধাকপি সুস্বাদু এবং উপকারী সবজি। এই সবজিতে আছে ভিটামিন ও খনিজ উপাদান, যা আমাদের শরীরের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন। আপনি শুনে হয়তো অবাক হবেন, শরীরের ওজন কমানোর মতো খাদ্য উপাদান আমাদের প্রয়োজন, যা বাঁধাকপি থেকেই আমরা পেতে পারি। এছাড়া ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ এবং হৃদপিন্ডের সুস্থতার জন্য বাঁধাকপির আছে অনন্য উপকারী গুন। আমরা এই নিবন্ধে জানবো বাঁধাকপির ইংরেজি নাম, বাঁধাকপি খাওয়ার উপকারিতা, খাদ্য উপাদান ও পুষ্টিগুণ এবং অপকারিতা সম্পর্কে।

বাঁধাকপির পরিচিতি

বাঁধাকপি অত্যন্ত পুষ্টিকর একটি সবজি। এটি একটি পাতাযুক্ত সবজি যা ব্রাসিকেসি পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। বাঁধাকপি কবে, কোথায়, কিভাবে খাওয়া শুরু হয়েছিল সেই সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়া না গেলেও অনেকের মতে- এর উৎপত্তি মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ ইউরোপে। খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ৪০০০ সালে প্রথম বাঁধাকপির চাষ করা হয়েছিল; এর উল্লেখ মিশরীয় পুঁথিতে পাওয়া যায়, যেখানে এটিকে “সোপি” নামে উল্লেখ করা হতো। এই সবজি গ্রীক এবং রোমানরা চাষ করতো, সেখানে তারা এটিকে ‘ক্যাপাস” এবং ‘ক্যাপুলাস” নামে অভি হিত করত।

বাঁধাকপি মধ্যযুগে ইউরোপে ব্যাপকভাবে চাষাবাদ শুরু হয়। সেই সময় সেখানে এই সবজিটি শীতকালে একটি গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য উৎস হিসেবে বিবেচিত হতো, কারণ অন্যান্য তাজা সবজিগুলোর সরবরাহ ছিল অত্যন্ত কম।

বাঁধাকপির বিভিন্ন ধরনের শ্রেণী রয়েছে, যার মধ্যে সাদা বাধাকপি, লাল বাঁধাকপি, সবুজ বাঁধাকপি। বিভিন্ন ধরনের বাঁধাকপির স্বাদ এবং পুষ্টি গুণও একটু আলাদা প্রকৃতির। বর্তমানে হাইব্রিড জাতের কিছু বাঁধাকপি যেমন বারি বাঁধাকপি ১ প্রভাতী, বারি বাঁধাকপি ২ অগ্রদূত, বারি চীনা বাঁধাকপি, ইপসা বাঁধাকপি ১ প্রভৃতি।

বাঁধাকপির ইংরেজি নাম

বাঁধাকপি একটি পুষ্টিকর সবজি। এটি ভিটামিন সি, ভিটামিন কে, ফাইবার এবং অন্যান্য খাদ্য উপাদানে সমৃদ্ধ। আপনি কি জানেন, এই বাঁধাকপির ইংরেজি শব্দ কি এবং কোন শ্রেণীর সবজি এটি। না জেনে থাকলে চলুন জেনে নেই। বাঁধাকপির ইংরেজি শব্দ হলো Cabbage (ক্যাবেজ) যা Brassicaceae (ব্রাসিকেসি) পরিবারের অন্তর্ভুক্ত।

কিভাবে খাওয়া যেতে পারে বাঁধাকপি

বাঁধাকপির আদি নিবাস দক্ষিণ ইউরোপে। তবে বর্তমানে উৎপাদক দেশ হিসেবে প্রথমে চীনের নাম উঠে আসে। এ ছাড়া পৃথিবীর অন্যান্য দেশ বিশেষ করে ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, রাশিয়া প্রভৃতি দেশেও বাঁধাকপির চাষ ব্যাপক হারে হয়ে থাকে। বাংলাদেশে ১৯৬০ এর দশকে এর চাষ ব্যাপক হারে শুরু হয়।

বাঁধাকপি বিভিন্নভাবে খাওয়া যেতে পারে, যেমন কাঁচা, রান্না করা অবস্থায় এবং শুকনো অবস্থায়। তবে পুষ্টিগুণ বিবেচনা করলে কোন পদ্ধতিতে এটি খাওয়া হচ্ছে সেটার উপর অনেকটাই নির্ভর করে। বাঁধাকপিতে আছে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার, ফোলেট, পটাশিয়াম, ভিটামিন এ, ভিটামিন কে, ম্যাঙ্গানিজ সহ আরো অনেক খনিজ উপাদান, যা আমাদের শরীরের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এছাড়া বাঁধাকপি স্যুপ,সালাদ, সটু এবং স্টার ফ্রাই হিসেবে খাওয়া যায়। পশ্চিমা দেশগুলোতে বাঁধাকপিকে স্যুয়া ক্রাউট, কিমচি বা অন্যান্য গাজনযুক্ত খাবার তৈরি করতে গাজানো বা পচানো হয়ে থাকে।

এই বাঁধাকপিতে রয়েছে সামান্য পরিমাণে কোলেস্টেরল ও ফ্যাট। আমাদের মধ্যে অনেকেই যাঁরা শরীরের অতিরিক্ত ওজন কমাতে আগ্রহী, তাঁরা খাদ্য তালিকায় অনায়াসেই রাখতে পারেন বাঁধাকপি। স্যালাড হিসেবে বাঁধাকপি খাওয়া হলে ক্যালরি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা খুব কম থাকে।


এই সবজিতে ভিটামিন ও খনিজ উপদান থাকার কারণে শরীরের রোগ প্রতিরোধক শক্তি বৃদ্ধি পায়। এছাড়া এতে "ইনডোল থ্রি কার্বিনল" নামের খনিজ উপাদান থাকার কারণে স্ত্রী হরমোন ওয়েস্ট্রজেনের পরিমাণ কমিয়ে টেস্টোস্টেরন হরমোনের মাত্রাকে বেশি কার্যকর করে তোলে।

বাঁধাকপি খাওয়ার উপকারিতা


বাঁধাকপির খাদ্য উপাদান ও পুষ্টিগুণ

বাঁধাকপি একটি পুষ্টিকর সবজি এবং ভিটামিন ও খাদ্যপ্রাণ এর একটি অন্যতম উৎস। অন্যান্য খাদ্য উপাদানের সাথে ভিটামিন সি, ভিটামিন কে, ফাইবার এবং অন্যান্য খনিজ উপাদান বাঁধাকপি থেকে পাওয়া যায় বলে পুষ্টিবিদরা মনে করেন। তাঁদের মতে- প্রতি ১০০ গ্রাম(বা ৩.৫ আউন্স) এর সমপরিমাণ বাঁধাকপিতে নিম্নলিখিত পুষ্টি উপাদান পাওয়া যায়-

  • ক্যালরি ২৫
  • প্রোটিন ১.০ গ্রাম
  • ফাইবার ২.৫ গ্রাম
  • কার্বোহাইড্রেট ৪.৯ গ্রাম
  • চর্বি ০.১ গ্রাম

এছাড়া ভিটামিন এবং খনিজ উপাদান রয়েছে

  • ভিটামিন সি- ৩৬.৬ মিলিগ্রাম
  • ভিটামিন বি৬- ০.১২৪ মিলিগ্রাম
  • ভিটামিন কে- ৪৭.৪ মাইক্রো গ্রাম
  • প্যানটেথেনিক অ্যাাসিড-০.২১২ মিঃ গ্রাম
  • আয়রন- ০.৪ মিলিগ্রাম
  • ক্যালসিয়াম- ২২ মিলিগ্রাম
  • ফোলেট- ৫৩ মাইক্রগ্রাম
  • ম্যাগনেসিয়াম- ১৮ মিলিগ্রাম
  • পটাশিয়াম- ১৮৬ মিলিগ্রাম

অন্যান্য পুষ্টি উপাদান হলো-
  • সালফার যৌগ- যা বাঁধাকপির সুগন্ধ ও স্বাদের জন্য অনেকাংশে দায়ী।
  • অ্যাান্থোসায়নিন- এটি একধরনের এন্টিঅক্সিডেন্ট যা বাঁধাকপির বিভিন্ন রঙের জন্য দায়ী।


বাঁধাকপি খাওয়ার উপকারিতা

বাঁধাকপি এমন একটি পুষ্টিকর সবজি যা স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য বিভিন্ন স্বাস্থ্য উপকারিতা প্রদান করে থাকে। চলুন আমরা জেনে নেই বাঁধাকপির স্বাস্থ্য উপকারিতা সম্পর্কে-

ক্যান্সার প্রতিরোধ

গবেষণায় দেখা গেছে যে, বাঁধাকপি খাওয়া হলে ক্যান্সারের মতো ঝুঁকি কমানো ও প্রতিরোধ করা সম্ভব। বিশেষ করে কোলন ক্যান্সার, স্তন ক্যান্সার এবং ফুসফুসের ক্যান্সার এর ঝুঁকি কমিয়ে দেয় বাঁধাকপি। গবেষকরা বলছেন- নিয়মিত বাঁধাকপি খাওয়ার ফলে কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি ২৪% কমে যেতে পারে। এছাড়া স্তন ক্যান্সারের মত ঝুঁকি কমাতে বাঁধাকপি সহ অন্যান্য ক্রুসিফেরাস সবজিগুলো বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। কারণ বাঁধাকপিতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং সালফার যৌগগুলো ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি এবং বিস্তার রোধ করতে বিশেষভাবে সাহায্য করে। এছাড়া এই যৌগগুলো কোষের ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে এবং ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি ও বিস্তার রোধ করতে লড়াই করে থাকে, ফলে ক্যান্সার প্রতিরোধ করা ও বিস্তার রোধ করা অনেকাংশে সম্ভব।

হৃদরোগ প্রতিরোধ করতে

বর্তমানে হৃদরোগ একটি গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা যা বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর প্রধান কারণ হিসেবে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা মতামত পোষণ করছেন। এই হৃদরোগ প্রতিরোধ করতেও বাঁধাকপির অপরিসীম ক্ষমতা রয়েছে। এতে থাকা ভিটামিন ও রাসায়নিক উপাদান গুলো হৃদরোগ প্রতিরোধ করতে বিশেষভাবে সাহায্য করে। বাঁধাকপিতে আছে ফাইবার কোলেস্টেরল, যা হৃদরোগের ঝুঁকি কমিয়ে দিতে পারে। এ কারণেই উচ্চ কোলেস্টেরল মাত্রা সম্পন্ন রোগীদের গবেষকরা বাঁধাকপি নিয়মিতভাবে খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন, যাতে করে কোলেস্টেরলের মাত্রা ১০% কমানো সম্ভব। এছাড়া বাঁধাকপিতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট গুলো শরীরের রক্তনালী গুলোকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে এবং রক্ত জমাট বাধা রোধ করতে সাহায্য করে।

ওজন কমাতে বাঁধাকপি

প্রতি ১০০ গ্রাম বাঁধাকপিতে মাত্র ২৫ ক্যালোরি খাদ্য উপাদান পাওয়া যায়। বাঁধাকপি কম ক্যালোরিযুক্ত এবং ফাইবার যুক্ত সবজি, যা ওজন কমাতে সাহায্য করে। এতে থাকা ফাইবার আপনার পেটকে দীর্ঘ সময় ধরে ভরা রাখতে সাহায্য করে, যা কম খাওয়ার দিকে পরিচালিত করতে পারে। এছাড়া এ ফাইবার বেশি পরিমাণ পানি শোষণ করে ফলে, আপনার হজম শক্তি উন্নত হয় এবং কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়।

LDL কোলেস্টেরল- এর মাত্রা কমাতে

LDL কোলেস্টেরল হল শরীরের খারাপ কোলেস্টেরল। চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা গবেষণায় দেখেছেন- প্রতিদিন দুইশ গ্রাম বাঁধাকপি নিয়ম করে খেলে এলডিএল কোলেস্টেরল এর স্তর ১০% কমে যায়। কারণ এতে আছে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার যা কোলেস্টেরল শোষণ করতে বিশেষভাবে সাহায্য করে।

রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা বা অ্যান্টিবডি বৃদ্ধি করতে

আমাদের শরীরের এন্টিবডি বা রোগ প্রতিরোধক শক্তি কমে গেলে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক উপসর্গ দেখা দিতে পারে। এই কমে যাওয়া রোগ প্রতিরোধক শক্তি বৃদ্ধি করতে বাঁধাকপি বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। কারণ বাঁধাকপিতে আছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি, যা একটি অন্যতম এন্টিঅক্সিডেন্ট। শরীরকে ক্ষতিকারক ফ্রি র‍্যাডিকেল থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে এটি। এছাড়া বাঁধাকপিতে ভিটামিন কে থাকার কারণে রক্ত জমাট বাঁধার মতো জটিলতা প্রতিরোধ করা যায়, যা বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণ ঝুঁকি কমাতে পারে।

কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে বাঁধাকপি

পুষ্টিবিদরা বলেন- বাঁধাকপি খাওয়া হলে কোষ্ঠকাঠিন্যর ঝুঁকি ৩০% কমে যেতে পারে, কারণ বাঁধাকপিতে থাকা ভিটামিন সি কোলন স্বাস্থ্যর উন্নতির জন্য এবং এতে থাকা ফাইবার পাকস্থলীর মলকে নরম করে তোলে, ফলে মলত্যাগের প্রক্রিয়া সহজ হয়।

উপসংহার

উদ্ভিদ বিজ্ঞানীদের মতে- বাঁধাকপি ব্রাসিকেসি বা ক্রুসিফেরি গোত্রের ব্রাসিকা অলেরাসিয়া প্রজাতির একটি উদ্ভিদ, যা অত্যান্ত পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ একটি সবজি। এটি একটি জনপ্রিয় সবজি হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যাপক হারে চাষ করা হয়ে থাকে। এতে থাকা পুষ্টিগুণ ও খাদ্য উপাদান গুলো আপনার শরীরের জন্য যেমন উপকার করতে পারে তেমনি অতিরিক্ত খাওয়া হলে কিংবা অনিয়ম করে খেলে হতে পারে অপকারিতা। যাই হোক অতিরিক্ত পরিমাণে বাঁধাকপি খাওয়া অথবা কাঁচা বাঁধাকপি সালাদ আকারে বেশি খাওয়া কিছু কিছু মানুষের জন্য ফোলাভাব, গ্যাস বা গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল ধরনের উপসর্গ নিয়ে আসতে পারে। সুতরাং উভয়দিকে লক্ষ্য রেখে আমাদের এই সবজিটি গ্রহণ করতে হবে। বৈচিত্র্যময় এই সবজি এবং সুষম খাদ্যের অংশ হিসেবে আমরা সবাই স্বাভাবিকভাবে এবং স্বাভাবিক মাত্রায় গ্রহণ করব বাঁধাকপি, এই অঙ্গীকার হোক আমাদের সবার।


আরো জানতে- মোবাইল ফোন সাথে নিয়ে ঘুমানো কতটা ক্ষতিকর?
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন