দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামীলীগের ইশতেহার ও আদিবাসী

ভূমিকা

বাংলাদেশের সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৮ সালে ৩০ ডিসেম্বর। দেশের একাদশতম এই জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ ভাবে জয় লাভ করে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল এই নির্বাচনে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ না করলেও পরোক্ষভাবে অংশ গ্রহণ করে। জাতীয় সংসদের এই নির্বাচনে ২য় স্থান লাভ করে বিএনপি'র নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। তৃতীয় স্থান এর মুকুট পড়ে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। যেহেতু একাদশ এই জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মেয়াদ শেষ হয় ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে সেহেতু জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ২০২৩ সালের শেষের দিকে অথবা ২০২৪ এর প্রথম দিকে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে আগামী ৭ জানুয়ারি ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দেশের 12 তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থাকায় ২০২৩ সালের ১৫ নভেম্বর নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করে। 

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামীলীগের ইশতেহার সারমর্ম

২০২৪ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ ইতিমধ্যে তাদের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছে। এই ইস্তেহারের মূল উপজীব্য বা বক্তব্য হলো ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে পদার্পণ বা উঠে আসা। ইশতেহার প্রণয়ন কমিটির সদস্যদের বক্তব্য হল- হুট করে কোন কিছু এই ইশতেহারে আনা হয়নি বরং ধাপে ধাপে বাংলাদেশের অগ্রগতির একটি স্মারক এখানে তুলে ধরা হয়েছে। এখানে উল্লেখ করা হয়েছে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি স্মার্ট বাংলাদেশ হিসেবে রূপান্তর করার কথা। এজন্য ২০২৫ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার নিশ্চিত করে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি স্মার্ট বাংলাদেশে পরিণত করা হবে।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামীলীগের ইশতেহার ও আদিবাসী

ডিজিটাল বাংলাদেশ ও স্মার্ট বাংলাদেশ

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তর করার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করেছিল ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে। সেখানে ‘দিন বদলের সনদ” এই স্লোগানে তাদের নির্বাচন ইশতেহারে ছিল ২০২১ সালের মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ করার অঙ্গীকার। এরপর দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ‘এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ” এই শিরোনামে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছিল। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০১৮ সালের আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের শিরোনাম ছিল ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ।" আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলটি তাদের নির্বাচনে স্লোগান ঠিক করেছে ‘ক্ষুধা দারিদ্র্যমুক্ত স্মার্ট বাংলাদেশ”-এ পদার্পণ। আওয়ামী লীগের এ দ্বাদশ নির্বাচন ইশতেহারে ১১ টি বিষয়ের উপর বিশেষভাবে জোর দেওয়া হয়েছে।

ইশতিহারের প্রতিফলন

গত ১৫ বছরে আওয়ামীলীগ সরকার দেশের অনেক উন্নয়ন সাধন করেছে এটা অস্বীকার করার নয়। এই উন্নয়নের প্রচার প্রসার এমন ভাবে করা হয়েছে তা লক্ষ্য করার মত। এই প্রচারণা মুঠো ফোনের মেসেজ এর মাধ্যমেও প্রসার পেয়েছে। কিন্তু লক্ষ্য করার বিষয় হলো ২০০৮ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত যে সকল নির্বাচনী ইশতেহার আওয়ামী লীগ সরকার দিয়ে এসেছিল সেখানে দেশের আদিবাসী জনগণের উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছিল সমতলের আদিবাসীদের জন্য ভূমি উন্নয়ন ব্যবস্থার পদক্ষেপ গ্রহণ, নির্যাতিত আদিবাসী জনগণের ন্যায় বিচার নিশ্চিতকরণ এবং আদিবাসীদের সংস্কৃতি উন্নয়ন ইত্যাদি। আবার পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের কথা জোর দিয়ে বলা হয়েছিল নির্বাচনী ইশতেহারে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই শান্তি চুক্তি ৩০ বছর পার হয়ে যাওয়ার পরেও বাস্তবায়ন করা হয়নি। তাহলে উন্নয়ন বলতে শুধুমাত্র দেশের অবকাঠামো উন্নয়নকে বুঝায় নাকি দেশের সংখ্যালঘু ও নিপীড়িত মানুষের সামগ্রিক উন্নয়ন সহ সামগ্রিক উন্নয়নকে বোঝানো হয়?

দেশের আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন আদিবাসী সংগঠনগুলো বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকম দাবি করে এসেছে। যেমন সাংবিধানিক স্বীকৃতি, ভূমি কমিশন গঠন, সংখ্যালঘু আদিবাসীদের উপর নির্যাতন বন্ধ, চাকুরীতে কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহাল, পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন ইত্যাদি। কিন্তু এই সকল দাবিগুলো সরকার কর্ণপাত করেনি বরং এগুলোকে আরো সংকুচিত ও খর্ব করার চেষ্টা চালানো হয়েছে।

অতীতের বিএনপি সরকারের মত আওয়ামী লীগ সরকারও বাংলাদেশ আদিবাসী নেই বিষয়টি স্পষ্ট ভাবে উল্লেখ করেছে এবং আদিবাসী শব্দ ব্যবহার না করার জন্য নোটিশ জারি করেছে। আদিবাসীদেরকে আদিবাসী হিসেবে পরিচিত না করে ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জাতি গোষ্ঠী হিসেবে পরিচিতি করানো, চাকুরীতে নির্ধারিত ৫% সংরক্ষিত আসন কোটা বাতিল করণ, আদিবাসীদের অধিকার খর্ব করার প্রক্রিষ্ট উদাহরণ।

বিগত বাজেট গুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায, আদিবাসীদের জন্য প্রাথম দিকে সামান্য কিছু থোক বরাদ্দের ব্যবস্থা রাখা হতো। কিন্তু বর্তমানে বিগত বাজেটে আদিবাসীদের জন্য কোন বরাদ্দই রাখা হয় না। এই পর্যায়ে যা করা হয় তা হল, প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ তহবিল থেকে আদিবাসীদের জন্য সামান্য কিছু প্রদান করা, যা আদিবাসীদেরকে দয়া করার নামান্তর।

আওয়ামীলীগের নির্বাচনী ইশতেহার ২০২৩ আদিবাসী

দেশের ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জাতি গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে আওয়ামীলীগ নির্বাচনী ইশতেহার ২০১৮ এ। এখানে ধর্মীয় ও ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জাতি গোষ্ঠী তথা আদিবাসী সম্প্রদায়ের প্রতি বৈষম্য মূলক আচরণ, তাদের, ভাষা, সাহিত্য, জীবন-জীবিকা, সম্পদ, উপাসনালয়, জীবনধারা ও সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য রক্ষা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অবসান সু প্রতিষ্ঠা করা হবে বলে দাবি করা হয়েছে। আর এটি বাস্তবায়নের জন্য যে সকল লক্ষ্য ও পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছে সেগুলো হল-

  • সমতলের আদিবাসীদের জন্য জমি জলাধার ও বন এলাকায় অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে ও ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী তথা আদিবাসীদের চাকুরীর ক্ষেত্রে বিশেষ কোটা ও সুযোগ সুবিধা প্রদান করা হবে
  • অর্পিত সম্পত্তি সংশোধনী আইনের মাধ্যমে প্রকৃত স্বত্বাধিকারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা হবে
  • ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের প্রতি বৈষম্যমূলক সকল প্রকার আইন ও অন্যান্য আইন ব্যবস্থার অবসান করা হবে
  • আদিবাসী সম্প্রদায়ের ছেলে মেয়েদের নিজস্ব ভাষায় শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করা হবে এবং আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায়ও শিক্ষিত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে

উপসংহার

বাংলাদেশে আদিবাসী জনগোষ্ঠী অতীতে বিভিন্ন সরকারের শাসনামলে বৈষম্য ও নিপীড়নের সম্মুখীন হয়েছে বারবার। তাই তাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের অগ্রগতি দারুণভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ২০২৩ সালে আওয়ামী লীগ নির্বাচন ইশতেহারে আদিবাসীদের উন্নয়নের জন্য যে সকল প্রস্তাবনা উত্থাপন করেছে সেগুলো বাস্তবায়িত হলে তবেই আওয়ামী লীগের স্মার্ট নির্বাচনী ইশতেহার প্রণয়ন সফল হবে।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন