বিশ্ব ইজতেমা কি, কোথায় হয় এবং এর উৎপত্তি

ভূমিকা

বিশ্ব ইজতেমা মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন বন্ধ ন শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। এই ইজতেমার মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মুসলমানরা একত্রিত হন এবং ইসলামের শিক্ষা সম্পর্কে জানতে পারেন। এটি মুসলিম ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের প্রতীক বটে। বিশ্ব ইজতেমায় বয়ান দাতারা ইসলামের মৌলিক শিক্ষার উপর গুরুত্ব আরোপ করে থাকেন। তারা মানুষকে ইসলামের পথে চলার আহ্বান জানান। তাদের মতে- ইসলামের পথে চললেই মানুষ সত্যিকারের শুদ্ধ শান্তি লাভ করতে পারে। এই নিবন্ধে থাকছে বিশ্ব ইজতেমা কি, এটি কে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং এর উৎপত্তি, বাংলাদেশে কেন এটি পালন করা হয়ে থাকে ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা।


বিশ্ব ইজতেমা কি, কোথায় হয় এবং এর উৎপত্তি

বিশ্ব ইজতেমা কি

বিশ্ব ইজতেমা হল তাবলীগ জামাতের বার্ষিক আন্তর্জাতিক সমাবেশ, যা বাংলাদেশের টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এই সমাবেশটি বিশ্বের সর্ববৃহৎ সমাবেশ এবং এটিতে অংশগ্রহণ করেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা। বিশ্ব ইজতেমার মূল উদ্দেশ্য হলো দ্বীনের দাওয়াত দেওয়ার লক্ষ্যে বেশি পরিমাণে জামাত আল্লাহর রাস্তায় বের করা। ইস্তেমায় অংশগ্রহণকারীরা ৩দিন ধরে বিভিন্ন বয়ান শুনেন, ইসলামের বিধানাবলী সম্পর্কে জানেন এবং নিজেদেরকে একজন সত্যিকারের মুসলমান হিসেবে গড়ে তোলার জন্য উদ্বুদ্ধ হন। বিশ্ব ইজতেমার প্রধান কার্যক্রম গুলি হল বয়ান, দোয়া মোনাজাত ও জামাত বের করা।

বয়ান- বিশ্ব ইজতেমার প্রথম দুদিন বিভিন্ন বয়ান হয়। এই বয়ানগুলিতে ইসলামের মূলনীতি আহকাম ইবাদত বন্দেগী আখলাক ও সমাজ সেবা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়।

দোয়া- বিশ্ব ইজতেমার শেষ দিন আখেরি মোনাজাত হয় এই মোনাজাতে সমগ্র মুসলিম উম্মাহর জন্য শান্তি সম্প্রীতি সমৃদ্ধি ও ঐক্য কামনা করা হয়।

মোনাজাত- বিশ্ব ইজতেমার শেষ দিন আখেরি মোনাজাত করা হয়।

জামাত বের করা- আখেরি মোনাজাত করার পর জামাত বের করা হয়। জামাত বের করা হলো তাবলীগ জামাতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। জামাত বের করে মুসলমানদের মধ্যে দ্বীনের দাওয়াত দেওয়া হয়।

বিশ্ব ইজতেমা মুসলিম উম্মাহর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই মহাসমাবেশের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মুসলমানরা একত্রিত হন এবং ইসলামের শিক্ষা সম্পর্কে জানতে পারেন।

বিশ্ব ইজতেমার উৎপত্তি কিভাবে হয়

বিশ্ব ইজতেমার উৎপত্তি হয় ভারতের উত্তর প্রদেশের মেওয়াত এলাকায়। ১৯২৬ সালে হযরত মাওলানা ইলিয়াস আখতার কান্ধলভি(১৮৮৫-১৯৪৪ খ্রী) এই এলাকায় তাবলীগ জামাতের কার্যক্রম শুরু করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা মানুষকে কেবলমাত্র মসজিদের মধ্যে রাখে না, বরং তাকে তার সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনেও সেটীকে বাস্তবায়ন করতে সহযোগিতা করে। তাই তিনি তাবলীগ জামাতের মাধ্যমে মুসলমানদের মধ্যে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষার প্রচার ও প্রসারের উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

তাবলীগ জামাতের কার্যক্রম প্রথম দিকে বিভিন্ন এলাকায় ছোট ছোট ইজতেমা আয়োজনের মাধ্যমে করা হয়। ১৯৪৬ সালের ঢাকার কাকরাইল মসজিদে তাবলীগ জামাতের প্রথম বার্ষিক সম্মেলন বা ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। এই ইজতেমায় ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মুসলমানরা অংশগ্রহণ করেন।

১৯৬৬ সালে ঢাকা টঙ্গীর পাগার গ্রামে তাবলীগ জামাতের প্রথম বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। এই ইজতেমায় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মুসলমানরা অংশগ্রহণ করেন। এরপর থেকে প্রতি বছর এই বিশ্ব ইজতেমা টঙ্গির তুরাগ নদীর তীরে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।

বিশ্ব ইজতেমার প্রতিষ্ঠাতা কে

বিশ্ব ইজতেমার প্রতিষ্ঠাতা হলেন হযরত মাওলানা ইলিয়াস আখতার কান্ধলভি। তিনি ১৮৮৫ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশের মোজাফফর নগর জেলার অন্তর্গত কান্দলায় সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন প্রসিদ্ধ আলেম মাওলানা ইসমাইল(রহ) এবং মা ছিলেন হাফেজা সফিয়্যাহ। বড় ভাই মাওলানা ইয়াহইয়াহ (রহ) সহ অন্যান্য সদস্যরা কোরআন তিলাওয়াত নামাজ ও অন্যান্য ইবাদতে সবসময় মগ্ন থাকতেন। এ কারণেই তার মা বিয়ের পরেও পুরো কোরআন হিফজ করেন।

স্থানীয় মক্তবে শুরু হয় মাওলানা ইলিয়াস এর পড়াশুনা। ছোটকাল থেকেই পড়ালেখায় অত্যন্ত মনোযোগী ও মেধাবী ছিলেন তিনি। পারিবারিক ঐতিহ্য অনুসারে শৈশবকালেই পবিত্র কোরআন হিফজ করেন। পড়াশুনার পাশাপাশি তিনি নিয়মিত জিকির, তাহাজ্জুদ ও দোয়ায় সময় কাটাতেন। তার বয়স যখন ১০ বছর তখন তিনি মাওলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গুহি (রহ) এর সান্নিধ্যে আসেন এবং সেখানে তিনি ২০ বছর বয়স পর্যন্ত সময় অতিবাহিত করেন। ১৯০৫ সালে গাঙ্গুহি (রহ) মৃত্যুবরণ করেন এবং সে পর্যন্ত মাওলানা ইলিয়াস গাঙ্গুহি (রহ) এর সান্নিধ্যে থাকেন। মাওলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গুহি অন্য কাউকে বাইয়াত না করালেও ছাত্র অবস্থায় ইলিয়াস (রহ) কে বাইয়াত করান।

১৯২০ সালে মেওয়াত অঞ্চলে দ্বীনি শিক্ষার মাধ্যমে তাবলীগের প্রাথমিক কার্যক্রম শুরু করেন মাওলানা ইলিয়াস আখতার (রহ)। প্রথম দিকে মক্তব শিক্ষার মাধ্যমে ব্যক্তি পর্যায়ে তাবলীগের কার্যক্রম শুরু হয়। পরবর্তীতে ১৯২৫ সালে দ্বিতীয় হজ্ব পালনকালে মদিনায় দীর্ঘ পাঁচ মাস অবস্থান করে তাবলীগের কার্যক্রম নিয়ে চিন্তা এবং গবেষণা করেন। এই সফর থেকে ফিরে এসে পুরোপুরিভাবে তাবলীগের কাজ শুরু করেন। ১৯৩৩ সালে তৃতীয়বারের মতো আবারো হজ্ব সফরে যান এবং ফিরে এসে আজীবন তাবলীগের কাজ করেন। এরপর ইসলাম ধর্ম প্রচার এবং প্রসারের জন্য তিনি দেশ-বিদেশে পাড়ি জমান এবং এর বাণী প্রচারে নিজেকে অত্যন্ত ব্যস্ত রাখেন। ১৯৪৪ সালের ১৩ জুলাই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পূর্বে অর্থাৎ মৃত্যুর আগের দিন তিনি তার পরিবারের সদস্য এবং অন্যান্যদেরকে জিজ্ঞাসা করেন-” আগামীকাল কি বৃহস্পতিবার?” উপস্থিত সকলের জবাব “হ্যাঁ”। এরপর তিনি বলেন-’ আমার কাপড়-চোপড় ভালো করে দেখো, তাতে কোন নাপাকি আছে কি না?” উপস্থিত সবাই জানায় যে, কাপড়-চোপড় নাপাকি নাই, পবিত্র আছে। এরপর তিনি অজু করে সবার সঙ্গে নিজের কক্ষে এশার নামাজ পড়েন এবং সবাইকে তার জন্য বেশি করে দোয়া করতে বলেন। ভোররাতে ফজরের আযানের আগেই তিনি ইন্তেকাল করেন।

বিশ্ব ইজতেমার উল্লেখযোগ্য দিক

বিশ্বের বৃহত্তম ধর্মীয় ইসলামী সমাবেশ বিশ্ব ইজতেমা। প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ মুসলমানরা এই মহাসমাবেশে অংশগ্রহণ করেন। এই বিশ্ব ইজতেমার উল্লেখযোগ্য দিকগুলো হলো-

ইসলামী শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রচার- বিশ্ব ইজতেমার মূল উদ্দেশ্য হলো ইসলামিক শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রচার। এই ইজতেমার মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মুসলমানরা ইসলামের মূলনীতি, আহকাম, ইবাদত বন্দেগী, আখলাক ও সমাজসেবা সম্পর্কে জানতে পারেন।

ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের প্রতীক ইজতেমা- বিশ্ব ইজতেমা মুসলিম ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের প্রতীক। এই সমাবেশের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুসলমানরা একত্রিত হন এবং ইসলামের শান্তি ও সম্প্রীতির বার্তা ছড়িয়ে দেন।

২০২৪ সালের বিশ্ব ইজতেমা কোথায় হবে

তাবলীগ জামাতের কার্যক্রম শুরুর দিকে ছোট ছোট ইজতেমার মাধ্যমে সম্পন্ন করা হতো। ১৯৪৬ সালে ঢাকার কাকরাইল মসজিদের সর্বপ্রথম তাবলীগ জামাতের প্রথম বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এরপরে বিভিন্ন জায়গায় ইজতেমার স্থান বিভিন্ন সময়ে নির্ধারণ কর হয়। তবে ১৯৬৬ সালে গাজীপুর জেলার টঙ্গীর পাগার গ্রামে তাবলীগ জামাতের প্রথম বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। এই বিশ্ব ইজতেমায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মুসলমানরা অংশগ্রহণ করেন। এরপর থেকেই প্রতি বছর এই বিশ্ব ইজতেমা টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে এবং এই স্থানটি প্রতিবছরের বিশ্ব ইজতেমার জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

২০২৪ সালের বিশ্ব ইজতেমার স্থান গাজীপুর জেলা টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে অবস্থিত। এই স্থানটি একটি বিশাল মাঠ। মাঠের মাঝখানে একটি বড় মঞ্চ। মঞ্চের সামনে একটি ওয়াজ খানা। ওয়াজ খানার পাশে একটি মসজিদ রয়েছে। মাঠের চারপাশে পয়ঃ নিষ্কাশন ব্যবস্থা, খাবার ও পানীয় ব্যবস্থা, চিকিৎসা কেন্দ্র ইত্যাদি স্থাপন করা হয়েছে।

২০২৪ এর বিশ্ব ইজতেমা তারিখ কবে? 

বিশ্ব ইজতেমার বয়ানদাতারা ইসলামের মৌলিক শিক্ষার উপর গুরুত্ব আরোপ করে থাকেন। তারা মানুষকে ইসলামের পথে চলার আহ্বান জানান। তাদের মতে- ইসলামের পথে চললেই শুধুমাত্র মানুষ সত্যিকারের সুখ ও শান্তি লাভ করতে পারে।

বর্তমানে বিশ্ব ইজতেমায় দেশ ও বিদেশের লক্ষ লক্ষ মুসলমান অংশগ্রহণ করার কারণে জায়গা সংকুলান না হওয়ার কারণে বিশ্ব ইজতেমাটি দুটি পর্বে অনুষ্ঠিত হয়। ২০২৪ সালের বিশ্ব ইজতেমাও দুটি পর্বে অনুষ্ঠিত হবে। প্রথম পর্ব ২ ফেব্রুয়ারি থেকে ৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এবং দ্বিতীয় পর্ব ৯ই ফেব্রুয়ারি থেকে ১১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। প্রথম পর্বে আলমি শূরার মাওলানা জুবায়েরপন্থী মুসল্লীরা বিশ্ব ইজতেমায় অংশগ্রহণ করবেন। দ্বিতীয় পর্বে মাওলানা স্বাদের অনুসারীরা অংশগ্রহণ করবেন।

উপসংহার

এ বিশ্ব ইজতেমার মূল লক্ষ্য হলো দ্বীনের দাওয়াত দেওয়ার জন্য বেশি পরিমাণে আল্লাহর পথে আসার জন্য অন্যদেরকে দাওয়াত করা অর্থাৎ ইসলামের বাণী প্রচার ও তা প্রসারের জন্য লক্ষ লক্ষ দেশ ও বিদেশের মুসলমান সমাজকে আহ্বান করা। এতে বাংলাদেশের মুসলমান সহ পৃথিবীর অন্যান্য রাষ্ট্র যেমন- ভারত, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সৌদি আরব, তুরস্ক, মিশর ও আফগানিস্তানের মুসলমানরা সমবেত হন এবং তাবলীগে অংশগ্রহণ করেন। তিন দিনব্যাপী এই মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় এবং শেষের দিন আখেরি মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনসংখ্যা, ভৌগলিক অবস্থান এবং বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতা ছাড়াও তাবলীগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা হযরত মাওলানা ইলিয়াস আখতার কান্ধলভি (রহ) এর সাথে বাংলাদেশের বিশেষ সম্পর্ক; বিশ্ব ইজতেমা বাংলাদেশে আয়োজন করার অন্যতম কারণ বলে অনেকেই মনে করেন। প্রতি বছরের ন্যায় ২০২৪ সালের বিশ্ব ইজতেমা সফল হোক এবং বাংলাদেশ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা অখুন্ন থাকুক এটাই সবার কাম্য।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন