ভুমিকা
বর্তমান রাজশাহী জেলার বাগমারা থানার বারনই নদীর তীরে অবস্থিত বিখ্যাত এই জেলার ঐতিহ্যবাহী তাহের পুর হাট। রাজশাহী শহর থেকে উত্তর-পূর্ব দিকে ৪৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই তাহেরপুর হাটটি। শহর থেকে বাস অথবা স্থানীয় কোন যানবাহনের মাধ্যমে আপনি পৌঁছে যাবেন এই তাহেরপুরে। আজকের নিবন্ধে তাহেরপুর কেন এবং কিসের জন্য বিখ্যাত সেই বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার প্রয়াস রাখছি।
রাজশাহী জেলা সম্পর্কে কিছু তথ্য
বাংলাদেশের উত্তর পশ্চিমে পদ্মা নদীর তীরে অবস্থিত রাজশাহী জেলা। মোট আয়তন ২৪০৭.০১ বর্গকিলোমিটার। এ জেলার পূর্ব দিকে নাটোর, উত্তরে নওগাঁ, পশ্চিমে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও কুষ্টিয়া এবং দক্ষিণে পদ্মা নদী দ্বারা বেষ্টিত এই জেলাটি। জেলার উৎপাদিত প্রধান অর্থকরী ফসল গুলো হল ধান, পাট, গম, ফলমূল এবং শাকসবজি। প্রধান প্রধান শিল্প গুলোর মধ্যে বস্ত্র শিল্প( রাজশাহী সিল্ক) চিনি শিল্প ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প অন্যতম। এই জেলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ এবং রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় অন্যতম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এখানে পুঠিয়া রাজবাড়ী, বাঘা মসজিদ, শাহ মখদুম মাজার, বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর সহ বেশ কয়েকটি ঐতিহাসিক স্থানের নিদর্শন রয়েছে এই জেলায়।
এছাড়া এখানে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী রাজশাহী কলেজ, টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, শারীরিক শিক্ষা কলেজ, ভোকেশনাল টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, পোস্টাল একাডেমী, পুলিশ একাডেমি, রেশম গবেষণা কেন্দ্র, হোমিওপ্যাথিক কলেজ, নার্সিং ইনস্টিটিউট, ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজি, আঞ্চলিক লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র,পদ্মা গার্ডেন, হাওয়াখানা, শিশু পার্ক ও চিড়িয়াখানা।
এছাড়া বিখ্যাত রাজশাহীর সিল্ক শাড়ী বাংলাদেশের বস্ত্র শিল্প খাতে অত্যন্ত জনপ্রিয়। এখানে রেশম সুতা ও রেশম বস্ত্র তৈরি করা হয়। ১৯৭৭ সালে রাজশাহী রেশম বোর্ড স্থাপন করা হয়। অন্যান্য কুটির শিল্পের মধ্যে রয়েছে বাঁশ, বেত, কাঠের কাজ, মৃত শিল্প ও সেলাই শিল্প।
সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিকাশে রাজশাহীর রয়েছে ঐতিহ্য। আদিবাসীদের কৃষ্টি কালচার ও সংস্কৃতি বিকাশ ও গবেষণার জন্য এখানে রয়েছে আদিবাসী কালচারাল একাডেমি। এছাড়া বাংলা সংস্কৃতির বিখ্যাত ভাওইয়া গান 'গম্ভীরা' রাজশাহীর অত্যন্ত জনপ্রিয় সংগীত।
প্রাচীন জনপদের অংশ এই শহরের আদি নাম ছিল মহাকাল গড়। মৌর্য, গুপ্ত, পাল,মোগল, সেন এবং ইংরেজরা এই অঞ্চলে শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। অনেকেই মনে করেন- পঞ্চদশ শতকের দিকে ভাতুরিয়া দিনাজপুরের জমিদার রাজা গণেশ এই অঞ্চলের শাসক ছিলেন। রাজা গনেশকে ‘রাজা শাহ’ নামে অনেকেই চিনতেন এবং তার নাম অনুসারে রাজশাহী নামকরণ করা হয়েছে।
নবাবী আমল ১৭০০ থেকে ১৭২৫ সালে নবাব মুর্শিদকুলী খান বংলার রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্য সমগ্র বাংলাদেশকে ১৩টি চাকলায় বিভক্ত করেন। এই ১৩টি চাকলার মধ্যে ‘চারুলা রাজশাহী’ চাকলাটি ছিল বৃহৎ চাকলা। বর্তমান পাবনা, ঢাকা, যশোর এবং পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান, নদিয়া এবং বীরভূম জেলা নিয়ে চারুলা রাজশাহী চাকলা নির্ধারিত হয় এবং এই চাকলার রাজস্ব আদায়ের দায়িত্বভার প্রথম দিকে হিন্দু জমিদার উদয় নারায়ণকে অর্পণ করা হয়। জমিদার উদয় নারায়ণ ছিলেন মুর্শিদকুলী খান এর সবচেয়ে বিশ্বস্ত ব্যক্তি, যার কারণে নবাব মুর্শিদকুলী তাকে রাজা উপাধি দিয়েছিলেন।
পরবর্তীতে নবাব মুর্শিদকুলী খান চারুলা রাজশাহী চাকলার রাজস্ব আদায়ের দায়িত্বভার নাটোরের রাজা রামজীবনকে প্রদান করেন। রাজা রামজীবন ১৭৩০ সালে মৃত্যুবরণ করলে দত্তক পুত্র রামকান্ত রায় রাজা হন। ১৭৫১ সালে রাজা রামকান্তের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী ভবানী ‘রানী ভবানী’ উপাধিতে ভূষিত হন এবং রাজ্যের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
মিঃ গ্র্যান্ট এর ভাষায়- রানী ভবানীর জমিদারকেই রাজশাহী বলা হত এবং চারুলা রাজশাহী চাকলার বন্দোবস্তের সময় রাজশাহী নামে বন্দোবস্ত করা হয়। অক্ষয় কুমার মৈত্রীর মতে- রানী ভবানীর দেয়া নামই হল রাজশাহী।
কেন বিখ্যাত রাজশাহীর তাহেরপুর?
ঐতিহ্যের গৌরবময় রাজশাহীর একটি উপজেলা বাগমারা। এই বাগমারা ছিল বনজঙ্গলে পরিপূর্ণ। বনে থাকতো ভয়ংকর সব প্রাণী বাঘ-বাঘিনী। কথিত আছে- একদিন এক লোক ভয়ংকর বাঘ এর আক্রমণের শিকার হন এবং তিনি তার হাতে থাকা লাঠি দিয়ে সেই বাঘকে মেরে ফেলেন। সেই থেকে এই জায়গার নাম 'বাগমারা' রাখা হয়। আবার অনেকেই বলেন- ব্রিটিশ আমলে ঘন জঙ্গল কেটে ঘরবাড়ি ও জনবসতি গড়ে ওঠার কারণে এই উপজেলার নাম বাগমারা করা হয়।এছাড়াও অনেকে মনে করেন- বাঘমারা থানা ভবন জমির উপর বিরাট একটি বাগান ছিল এই বাগানটি কেটে থানা ভবন নির্মাণের কারণে এই জায়গার নাম বাগমারা রাখা হয়।
এই বাগমারা উপজেলার সুপ্রাচীন একটি জায়গা হল তাহেরপুর, যা দেশ ও বিদেশে বিশেষভাবে পরিচিতি লাভ করেছে। ইতিহাসবিদদের মতে- বাংলার বারো ভূঁইয়ার অন্যতম তাহের ভূঁইয়া সদলবলে তাহেরপুর আসেন এবং তার নামানুসারে তাহেরপুর নামকরণ করা হয়। তাহের ভূঁইয়া ইংরেজদের খাজনা দিতে অস্বীকৃতি জানালে ইংরেজ সেনাবাহিনী তাহের ভূঁইয়াকে যুদ্ধের মাধ্যমে পরাজিত করে এবং রাজা কংস নারায়নকে খাজনার বিনিময়ে তাহেরপুরের রাজত্ব প্রদান করে। বাগমারা উপজেলা প্রতিষ্ঠা করা হয় ১৯৮৩ সালে।
উপমহাদেশের প্রথম শারদীয় দুর্গোৎসব
রাজা কংস নারায়ণ ছিলেন একজন মহৎ দয়াশীল এবং ধর্মভীরু রাজা। ইতিহাসের তথ্য অনুযায়ী জানা যায়- পঞ্চদশ শতকের প্রথম দিকে কামদেব ভট্ট নামে একজন রাজা তাহেরপুরে রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। রাজা কামদেব ভট্ট এর উত্তরাধিকার সূত্রে রাজা হন কংস নারায়ন রায় বাহাদুর। তিনি বিশ্ববাসীর কল্যাণ ও শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য অশ্বমেধ যজ্ঞ করেন। সে সময় রাজপতি রমেশ শাস্ত্রী রাজা কংস নারায়ন বাহাদুর কে অকালবোধনের মাধ্যমে অসময়ে দূর্গা পূজা আয়োজন করার পরামর্শ দেন।
রাবণ বধে শ্রীরামচন্দ্রের অকালবোধনের মাধ্যমে শরৎকালে দুর্গাপূজার বর্ণনা শুনে রাজা কংস নারায়ন রায় বাহাদুর দুর্গাপূজা আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেন। বাংলা ৮৮৭ সালের আশ্বিন মাসের মহা ষষ্ঠী তিথিতে অকালবোধনের মাধ্যমে রাজা কংস নারায়ন দেবী দুর্গার প্রতিমা গড়ে প্রথম দুর্গাপূজার আয়োজন করেন। এরপর থেকেই শরৎকালের দুর্গাপূজা ছড়িয়ে পড়ে সারা ভারতবর্ষে। শক্তির উপাসনা করতে গিয়ে রাজা কংস নারায়ন বাহাদুর ১৪৮০ খ্রিস্টাব্দে(মতান্তরে ১৪৮২ ইংরেজি সাল) প্রথম দুর্গাপূজা করেন।
বিভিন্ন তথ্যসূত্র থেকে জানা যায়- প্রথম দুর্গাপূজায় রাজা কংস নারায়ন ব্যয় করেন ৯ লক্ষাধিক টাকা। এছাড়া রাজা কংস নারায়ন তাহেরপুরের পাশাপাশি গোবিন্দ মন্দির, শিব মন্দির, দুর্গা মাতা মন্দির, কালী মন্দির নামে আরো চারটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এর পরবর্তীতে রাজার বংশধররা ভারতে চলে গেল.১৯৬৭ সালে রাজবাড়ী সহ সব জমি লিজ নিয়ে গড়ে তোলা হয় তাহেরপুর ডিগ্রী কলেজ। সনাতন হিন্দু সম্প্রদায়ের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৩ সালে মন্দির গুলো আবার খুলে দেওয়া হয়।
বর্তমানে শারদীয় দুর্গোৎসবের তীর্থস্থান রাজা কংস নারায়ন রায় বাহাদুরের ৫৩৭ বছরের প্রাচীন এই রাজবাড়ীতে বসানো হয়েছে অষ্টধাতুর দুর্গা প্রতিমা। অষ্টধাতুর তৈরি এই দুর্গা প্রতিমার উচ্চতা ১০ ফিট। অনেকেই দাবি করছেন এই দুর্গা প্রতিমা ভারত উপমহাদেশের মধ্যে সবচাইতে বড় এবং শ্রেষ্ঠ অষ্টধাতুর প্রতিমা। এ খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে অনেক দূর-দূরান্ত থেকে দর্শনার্থী ভিড় করেন এই মন্দিরটি দেখার জন্য।
উপসংহার
বাগমারা তাহেরপুর ঐতিহাসিক এ মন্দিরটি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে একটি তীর্থস্থান। ইতিমধ্যেই মন্দিরটিকে জাতীয় দুর্গা মন্দির এবং দেবী দুর্গার প্রথম আবির্ভাবস্থল হিসেবে স্বীকৃতির জন্য সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় আবেদন করা হয়েছে। এই মন্দিরের উন্নয়নের জন্য বিশেষভাবে ভূমিকা রেখে চলেছেন সাবেক সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক। তার মতে- সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র স্থানটি একটি পুরাকীর্তির অংশ এবং এটির উন্নয়নের জন্য তিনি দৃষ্টিনন্দন মন্দির কমপ্লেক্স নির্মাণের যাবতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। এজন্য তিনি নিজের অর্থায়নেই মন্দিরে কষ্টিপাথরের মূর্তি তৈরির জন্য মানিকগঞ্জের ধামরাই থেকে প্রতিমা কারিগর নিয়ে এসেছেন এবং কষ্টিপাথর দিয়ে প্রতিমা তৈরি করে দিয়েছেন।এছাড়া ইতিপূর্বে ২২ লক্ষ টাকা খরচ করে তিনি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দুর্গাপূজা উৎসব পালনের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।