ভুমিকা
পুরুষ ও মহিলা উভয়ের শরীরেই বিভিন্ন ধরণের প্রজনন হরমোন থাকে। এই হরমোনগুলি জৈবিক ঘড়ির মত কাজ করে থাকে, যেমন- যৌন পরিপক্কতা, প্রজনন চক্র, গর্ভধারণ, গর্ভাবস্থা, প্রসব এবং স্তন্যপানের মতো গুরুত্বপূর্ণ শারীরিক পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণ করে। আজকের প্রবন্ধে থাকছে প্রজনন কার্যক্রমকে নিয়ন্ত্রণকারী এবং পরিচালনাকারী কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয় হরমোন সম্পর্কে আলোচনা। এই প্রবন্ধ থেকে আপনি জানবেন হরমোন কি এবং প্রজনন হরমোন কিভাবে আমাদের প্রজনন কার্যক্রমকে পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করে সেই সম্পর্কে।
প্রজনন হরমোন কি?
হরমোন হল- এক ধরনের জৈব-রাসায়নিক তরল, যা শরীরের কোনো কোষ বা গ্রন্থি থেকে শরীরের নির্দিষ্ট অংশে নিঃসরিত হয়ে রক্তরস বা ব্যাপন প্রক্রিয়ায় উৎপত্তিস্থল থেকে দূরে বাহিত হয়ে দেহের বিভিন্ন বিপাকীয় ক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে এবং ক্রিয়ার পর ধ্বংস প্রাপ্ত হয়। হরমোন শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ও কোষের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করে জীবনকে করে তোলে গতিময়। একটি স্বাভাবিক জীবন এর জন্য হরমোনের ব্যপক ভূমিকা রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে স্টেরয়েড জাতীয় হরমোন (যেমন এস্ট্রোজেন, প্রোস্টাগ্ল্যান্ডিন), অ্যামাইনো অ্যাসিড (যেমন অক্সিন), আইকোসানয়েড জাতীয় হরমোন (যেমন ইনসুলিন), গ্যাস জাতীয় হরমোন (যেমন ইথিলিন) ইত্যাদি।
পুরুষ হরমোন
মানব জীবনে হরমোনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই হরমোন মানব শরীরকে সুস্থ রাখতে এবং পরিচালনা করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। তবে পুরুষ ও নারী দেহের হরমোন সব গুলোই একই ধরনের নয়। এ কারণে হয়তো পুরুষ এবং নারী দেহের গঠন ও প্রকৃতি ভিন্ন ভিন্ন। পুরুষ শরীরের মধ্যে কিছু আলাদা হরমোন রয়েছে যেটি নারী দেহের মধ্যে কোন অস্তিত্ব নেই। চলুন জেনে নেই পুরুষ হরমোন গুলো সম্পর্কে।
টেস্টোস্টেরন-
টেস্টোস্টেরন হরমোন হলো পুরুষদের প্রাথমিক যৌন হরমোন এবং এনাবলিক স্টেরয়েড। এটি পুরুষ প্রজনন টিস্যু বা অঙ্গ যেমন টেস্টিস( অন্ডকোষ) এবং প্রস্ট্রেটের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়া এই হরমোন মানব শরীরের পেশী এবং হাড়ের ঘনত্ব বা ভর বৃদ্ধি এবং শরীরের চুল বৃদ্ধির মত গৌণ কার্যাবলী সম্পন্ন করে থাকে। পুরুষ ও মহিলা উভয়ের ক্ষেত্রে মেজাজ, আচরণ এবং অস্টিওপোরোসিস প্রতিরোধের জন্য টেস্টোস্টেরন হরমোন বিশেষভাবে ভুমিকা পালন করে থাকে। পুরুষদের অন্ডকোষ প্রাথমিকভাবে টেস্টোস্টেরন হরমোন উৎপাদন করে। আবার মহিলাদের ডিম্বাশয়ও এই হরমোন তৈরি করে তবে খুব কম পরিমাণে। বয়ঃসন্ধির সময় এর উৎপাদন উল্লেখযোগ্য ভাবে বৃদ্ধি পায় এবং ৩৫ বা তার বেশি বয়সের পরে এর উৎপাদন আস্তে আস্তে কমতে শুরু করে।
লুটেইনাইজিং হরমোন (LH)-
লুটেইনাইজিং হরমোন হলো পিটুইটারি গ্রন্থি দ্বারা উৎপাদিত একটি গোনাডোট্রপিন হরমোন। এটি প্রজনন কার্যের জন্য বিশেষ ভূমিকা পালন করে। পুরুষের যৌন শক্তি বৃদ্ধি এবং স্বল্পতা নিয়ন্ত্রণে এর ভূমিকা রয়েছে। এই হরমোন পুরুষদের শুক্রাশয় কে উদ্দীপ্ত করে টেস্টোস্টেরন এবং শুক্রানু উৎপাদন করে। পুরুষদের শরীরে এর স্বাভাবিক স্তর ২.৫ – ৯.০ IU/L। তবে এই স্বাভাবিক স্তর লিঙ্গ, বয়স, উচ্চতা, মহিলাদের মাসিক চক্র এবং সময়ের উপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হয়। এই হরমোন স্তরের পরীক্ষা রক্ত বা প্রস্রাব পরীক্ষা দ্বারা পরিমাপ করা যেতে পারে।
- ফলিকুলার পর্যায়ে-১.৫-১০.০ IU/L
- লুটোল পর্যায়ে-১০- ৮০.০ IU/L
- মধ্যচক্র পর্যায়ে( ডিম্বোসফটনের সময়)-২০.০- ৮০.০ IU/L
ফলিক্যাল স্টিমুলেটিং হরমোন(HSH)
এই হরমোন টেস্টোস্টেরন উৎপাদন এবং স্বল্পতা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। এর মুখ্য কাজ হল শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের সেল প্রসারণ এবং বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করা। মস্তিষ্কের পিছন দিকে অবস্থিত একটি ছোট্ট গ্রন্থি পিটুইটারি গ্রন্থি। এই গ্রন্থি থেকেই উৎপন্ন হয় ফলিক্যাল স্টিমুলেটিং হরমোন(HSH)। এটি পুরুষ এবং নারী দেহের প্রজনন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পুরুষদের শুক্রাশয়ের বিকাশ এবং শুক্রাণু উৎপাদনে সাহায্য করে এই হরমোন। মহিলাদের মধ্যে ডিম্বাশয় এর বিকাশ এবং ডিম্বাণু উৎপাদনে সাহায্য করে। এছাড়া এস্ট্রোজেন উৎপাদনকেও উদ্দীপিত করে এই হরমোন।
নারী হরমোন
মহিলাদের শরীরে টেস্টোস্টেরন লুটেনাইজিং ফলিকল স্টিমুলেটিং হরমোন ছাড়াও আরো কিছু হরমোন শরীরের গঠন এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কাজ করে থাকে সেগুলো হল-
এসট্রোজেন হরমোন-
এসট্রোজেন হরমোন হলো- একটি প্রধান স্ত্রী হরমোন যা মহিলাদের স্তন, যৌন অঙ্গ, গর্ভাশয় এবং অন্যান্য অঙ্গ গুলোর উন্নতি, পরিচালনা ও পরিবর্তনের জন্য বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এটি মূলত শরীরের ওভারিয়ান ও পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে উৎপন্ন হয়। এই হরমোন সাধারণত ফলিক্যাল উৎপন্ন করে এবং গর্ভ নিষেধক হরমোন প্রজেস্টেরন উৎপাদনের সহায়ক ভূমিকা পালন করে। মহিলাদের গর্ভাবস্থা, মাসিক চক্র, বয়স, সময়ের পরিবর্তন, শরীরের হাড়, চর্ম, মাংসপেশী ও স্তনের উন্নতি এবং পরিচালনায় এই হরমোন গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। এই হরমোনের আধিক্য এবং অভাবে মহিলাদের স্বাস্থ্য এবং কার্যক্ষমতা প্রভাবিত হতে পারে এবং প্রজনন সমস্যা ও অন্যান্য সমস্যার কারণ হতে পারে।
প্রজেস্টেরন হরমোন-
এটি গর্ভ অবস্থা এবং স্তন্যপানির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। গর্ভাবস্থা ও স্তন্যপান নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
ফলিক্যাল স্টিমুলেটিং হরমোন(HSH)
এটি মহিলাদের যৌন যন্ত্র গুলি বৃদ্ধি রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনার জন্য অনুরোধ করে থাকে
লুটেইনাইজিং হরমোন (LH)-
পুরুষদের শরীরের মতোই নারী দেহে লুটেইনাইজিং হরমোন নারী শরীরের বিশেষ যন্ত্র গুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কাজ করে থাকে। এই হরমোন নারীদের ডিম্বাণু উৎপাদন ও ডিম্বস্ফোটন প্রক্রিয়াকে উদ্দীপ্ত করে, ফলে সন্তান ধারণ সহজ হয়।
প্রজনন হরমোনের অভাবে মানবদেহের সমস্যা
প্রজনন হরমোনের অভাবে নারী ও পুরুষ শরীরে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। চলুন সেই সম্পর্কে আমরা জেনে নেই-
হরমোনের অভাবে পুরুষদের সমস্যা
- পুরুষের যৌন ইচ্ছা ও যৌন ক্ষমতা কমে যাওয়া
- বীর্য উৎপাদন কমে যাওয়া এবং সন্তান জন্মদানে ব্যর্থ হওয়া
- লিঙ্গ শৃঙ্গের আকার এবং বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়া
- অস্টিওপোরোসিস বা হার ক্ষয় রোগ লক্ষণ দেখা দেওয়া
প্রজনন হরমোনের অভাবে নারীদের সমস্যা
- নারীদের মাসিক চক্র অনিয়মিত এবং অনির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত চলতে থাকা
- গর্ভধারণের সম্ভাবনা কমে যাওয়া
- বিভিন্ন ধরনের নারী/স্ত্রী রোগ যেমন অনিয়মিত রজঃ স্রাব, প্রদর,গ র্ভ স্রাব ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দেওয়া
- অস্টিওপোরোসিস বা হাড় ক্ষয় লক্ষণ দেখা দেওয়া
উপসংহার
প্রজনন হরমোন আমাদের শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই হরমোন গুলো আমাদের প্রজনন ক্ষমতা যৌন স্বাস্থ্য এবং সামগ্রিক সুস্থতার জন্য অপরিহার্য।
সতর্কতাঃ এই প্রবন্ধের উল্লেখিত তথ্য শুধুমাত্র তথ্যগত উদ্দেশ্য ে উদ্দেশ্যে। প্রজনন হরমোনের অভাবজনিত কোন ঔষধ সেবন করার আগে অবশ্যই একজন অভিজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে ঔষধ সেবন করতে হবে।
এই বিষয়ে আরো জানতে- প্রজনন হরমোন গুলো কি কি?