কোটা ব্যবস্থার উৎপত্তি কিভাবে হয়?
কোটা হল কোন একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর জন্য কোন নির্দিষ্ট সংখ্যক স্থান বা সম্পদের বন্টন কে বোঝানো হয়। একটি দেশের সামাজিক অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীগুলোকে মূল ধারার সাথে এগিয়ে নেওয়ার জন্য মূলত কোটা ব্যবস্থা চালু করা হয়।
কোটা ব্যবস্থা প্রথম উৎপত্তি হয় ১৯০০ সালের শুরুর দিকে। ব্রিটিশ শাসন আমলে ভারতবর্ষের বিভিন্ন ধর্ম ও জনগণের মধ্যে বৈষম্য দূর করার জন্য সেসময় মূলত কোটা নীতি গ্রহণ করা হয়। এরপর ১৯৫০ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর ভারতীয় সংবিধানে তপশিলি শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত জনসাধারণের জন্য কোটা ব্যবস্থা সংরক্ষণ করা হয়। এই কোটা ব্যবস্থা সংরক্ষণের মূল উদ্দেশ্য ছিল সামাজিক অর্থনৈতিক এবং শিক্ষাগত দিক থেকে পিছিয়ে পড়া জনগণের উন্নয়ন ও সমঅধিকার নিশ্চিত করা।
বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর ১৯৭২ সালে প্রথম কোটা ব্যবস্থা আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয়। সেসময় দেশের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা, জেলা কোটা, নারী কোটা, আদিবাসী কোটা ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের কোটা ধীরে ধীরে যোগ হতে থাকে। মূলত কোটা ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য হলো দেশের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীগুলোকে মূলধারার সাথে সমান তালে উন্নয়নের দিকে এগিয়ে নেওয়া এবং দেশের সার্বিক উন্নয়ন সাধন করা।
একটি দেশের অর্থ নৈতিক উন্নয়নে কোটা ব্যবস্থার প্রয়োজন আছে কি?
একটি দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সার্বিক উন্নয়নের জন্য কোটা ব্যবস্থা গুরুত্ব রয়েছে। তবে কোটা ব্যবস্থা কি রকম হবে, সেই বিষয়টি সেই দেশের পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি এবং প্রেক্ষাপট অনুযায়ী নির্ধারিত হয়। চলুন সেই বিষয় সম্পর্কে একটু জেনে নেই-
সুবিচার ও ক্ষমতার ভিত্তিতে একটি দেশের কোটা ব্যবস্থা নির্ধারণ হয়ে থাকে। সমাজে বিভিন্ন ধর্ম জাতি বা শ্রেণীর মধ্যে যে বৈষম্য লক্ষ্য করা যায়, তা দূর করার জন্য কোটা ব্যবস্থা প্রয়োজন.। এতে পিছিয়ে পড়া জনগণের জন্য অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়।
অর্থনৈতিক উন্নয়ন যারা শিক্ষাগত এবং অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়ে তাদের মধ্যে দক্ষতা ও প্রতিযোগিতা মূলক শ্রম বাজারে অংশ গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টির জন্য কোটা ব্যবস্থা প্রয়োজন আছে।
দেশের সকল শ্রেণীর জনগণের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে কোটা ব্যবস্থা প্রয়োজন। এতে দেশের সুশাসনের প্রতিষ্ঠা হয়।
মানব সম্পদ উন্নয়ন একটি দেশের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে পিছনে ফেলে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন কখনোই সম্ভব নয়।পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীদের মধ্যে মানবসম্পদ উন্নয়নের মাধ্যমে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব। এ কারণেই কোটা ব্যবস্থা প্রয়োজন রয়েছে।
সামাজিক শান্তি, বৈষম্য এবং অসন্তোষ দুর্নীকরণে কোটা ব্যবস্থা কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। কারণ এটি আলাদা আলাদা জনগণের মধ্যে সমন্বয় ঘটায় এবং সামাজিক শান্তি নিশ্চিত করে।
সুতরাং কোটা ব্যবস্থার উদ্দেশ্য এবং বাস্তবায়ন দিয়ে সঠিকভাবে পর্যালোচনা করে এর প্রভাব এবং প্রয়োজনীয়তা নির্ধারণ করতে পারলেই কোটা ব্যবস্থা সফল হয়।
বাংলাদেশের কোটা ব্যবস্থা নিয়ে চলমান আন্দোলন
বাংলাদেশের কোটা ব্যবস্থা নিয়ে ছাত্র আন্দোলন নিয়মিত ভাবেই হয়ে এসেছে। সরকারি চাকরি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি ইত্যাদি ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থার সংখ্যা ও পরিমাণ নিয়ে আলোচনার সমালোচনা হয়ে আসছে অনেক আগে থেকে। ২০২৩ সালের শেষের দিকে এবং ২০২৪ সালের শুরুর দিকে কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসে। তাদের দাবি পূর্বের কোটা ব্যবস্থার সংখ্যা নামিয়ে আনা এবং মেধার ভিত্তিতে কোটার সংখ্যা ও পরিমাণ নির্ধারণ করতে হবে। বৈষম্য বিরোধী কোটা আন্দোলনকারীরা তাদের দাবিতে কোটার সংখ্যা সর্বোচ্চ ১০ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনার পক্ষে আন্দোলন শুরু করে। বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কারীদের সাথে আলোচনার মাধ্যমে কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করে। শিক্ষার্থীদের দাবি ও দেশের অনান্য জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের কথা চিন্তা করে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ৯৩% মেধা কোটা, ৫% মুক্তিযোদ্ধা কোটা, ১% ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠী কোটা এবং ১% প্রতিবন্ধী ও হিজরা জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা ব্যবস্থা চড়ান্তভাবে নির্ধারন করে। কিন্তু এরপরও বৈষম্য বিরোধী কোটা আন্দোলনকারীরা অনান্য দাবি আদায়ের জন্য তাদের আন্দোলন চালিয়ে যায়। দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো কোটা ব্যবস্থার আন্দোলনকে পুঁজি করে রাজনৈতিক চরিতার্থ হাসিল করার জন্য তাদের নিজেদের অবস্থান নিশ্চিত করে এবং আন্দোলনকারীদের সমর্থন করে। আবার কোন কোন দল এর বিরোধিতা করে।মূলত কোটা বিরোধী আন্দোলন শুধুমাত্র কোটা বিরোধী আন্দোলনে না থেকে এটি রূপ নেয় সরকার পতনের আন্দোলনে। দেশের প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল, যারা কোটা আন্দোলনের সমর্থনকারী, তারা এই কোটা আন্দোলন নিয়ে সরকার পতনের আন্দোলনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।
কোটা ব্যবস্থার বিকল্প কি হতে পারে?
কোটা ব্যবস্থার বিকল্প হিসাবে বিভিন্ন প্রস্তাবনা থাকতে পারে, যার লক্ষ্য সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষদের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করা। কিছু সম্ভাব্য বিকল্প হলো:
অর্থনৈতিক সহায়তা: দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া জনগণের জন্য অর্থনৈতিক সহায়তা ও বৃত্তি প্রদানের ব্যবস্থা। এতে যোগ্যতাসম্পন্ন ছাত্রদের জন্য বিভিন্ন ধরনের স্কলারশিপ প্রদান করা যেতে পারে।
শিক্ষামূলক উন্নয়ন: পিছিয়ে পড়া অঞ্চলের শিক্ষার মান বৃদ্ধির জন্য নতুন কর্মসূচি গ্রহণ করা। বিশেষ করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা উন্নত করার উপর জোর দেওয়া।
সামাজিক সচেতনতা: সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সমাজের সকল স্তরের মানুষের মধ্যে সুযোগ সমান করার প্রচেষ্টা চালানো।
কম্পিটিটিভ পরীক্ষা: পারফরম্যান্স ভিত্তিক নিয়োগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যোগ্যতা মূল্যায়ন করা। এতে যোগ্য প্রার্থীদের সুযোগ দেওয়ার পাশাপাশি সক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে।
ক্ষমতা ও সুযোগের সমবণ্টন: সরকারি ও বেসরকারি খাতে ক্ষমতা ও সুযোগের সমবণ্টনের জন্য বিশেষ নীতিমালা তৈরি করা।
উদ্যোক্তা উন্নয়ন: উদ্যোক্তাদের জন্য প্রশিক্ষণ ও সহায়তা প্রদান করে নতুন উদ্যোগ শুরু করার সুযোগ তৈরি করা।
এগুলো ছাড়াও, বিভিন্ন দেশে এবং সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে ভিন্ন ভিন্ন বিকল্প প্রস্তাবিত হতে পারে।