কোটা ব্যবস্থা কী?
সাধারণত কোটা ব্যবস্থা হল সুযোগ-সুবিধা সংরক্ষণ করা অর্থাৎ কোটা ব্যবস্থা বলতে কোন এক বা একাধিক নির্দিষ্ট শ্রেণীভুক্ত লোকদের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি অথবা চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা। মূলত দেশের অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে সমতার ভিত্তিতে এগিয়ে নেওয়ার জন্য এবং কর্মসংস্থান এর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীকে মূল ধারার সাথে উন্নয়নের জন্য এই কোটা প্রথার প্রবর্তন করা হয়। এই ব্যবস্থার লক্ষ্য হলো সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া শ্রেণির লোকদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করা। অতীতে বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধা, নারী, জেলা কোটা, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য কোটা ছিলো।
কোটা ব্যবস্থা কেমন হতে পারে?
কোটা ব্যবস্থা বিভিন্ন দেশের মধ্যে ভিন্নভাবে কার্যকরী হতে পারে, যেমন:
১। শিক্ষা ক্ষেত্র- কোনও বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজে সংখ্যালঘু গোষ্ঠী বা economically weaker sections (EWS) এর জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ আসন সংরক্ষণ।
২। সরকারি চাকরি- সরকারি চাকরিতে কিছু নির্দিষ্ট সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর জন্য আসন সংরক্ষণের মাধ্যমে বৈষম্য কমানোর চেষ্টা।
৩। রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব- কিছু দেশে রাজনৈতিক পদে সংখ্যালঘু জনগণের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার জন্য কোটা ব্যবস্থা রাখা হয়।
ভারতে শিক্ষায় এবং সরকারি চাকরিতে বিভিন্ন সমাজের জন্য কোটা ব্যবস্থা রয়েছে, যা সামাজিক সমতা এবং উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে, এটি কখনও-কখনও বিতর্কিত বিষয়ও হয়ে থাকে, কারণ কিছু সমালোচকেরা মনে করেন যে এটি অন্যদের প্রতি বৈষম্য সৃষ্টি করতে পারে।
বিভিন্ন রাষ্ট্রের কোটা ব্যবস্থা
বিভিন্ন রাষ্ট্রে কোটা ব্যবস্থা বিভিন্ন সংস্কৃতি, সামাজিক অবস্থান এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়। এখানে কিছু দেশের কোটা ব্যবস্থার উদাহরণ দেওয়া হলো:
ভারত
ভারতে কোটা ব্যবস্থা সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠীগুলির জন্য সংরক্ষণ করে। ভারত সরকারের বিভিন্ন স্তরে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে:
- **সামাজিক গোষ্ঠী**: SC (Scheduled Castes), ST (Scheduled Tribes) এবং OBC (Other Backward Classes) এর জন্য নির্দিষ্ট আসন সংরক্ষিত।
- **EWS (Economically Weaker Sections)**: অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল সম্প্রদায়ের জন্যও কিছু আসন সংরক্ষিত থাকে।
যুক্তরাষ্ট্র
যুক্তরাষ্ট্রে "Affirmative Action" নীতি অনুসারে, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলি এবং মহিলা শিক্ষার্থীদের জন্য কিছুটা সুবিধা প্রদান করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়। তবে এটি রাজ্য অনুযায়ী ভিন্নতা রয়েছে এবং কিছু ক্ষেত্রে বিরোধিতা ও আইনি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে।
দক্ষিণ আফ্রিকা
দক্ষিণ আফ্রিকায় "Black Economic Empowerment" (BEE) নীতি অনুযায়ী, সার্বিক ভাবে আফ্রিকান বা সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলির উন্নয়নের জন্য সরকারি চাকরিতে ও ব্যবসায় কোটা ব্যবস্থা রয়েছে। এই ব্যবস্থা ১৯৯৪ সালে বর্ণবিদ্বেষী শাসনের পরবর্তী সময়ে গৃহীত হয়।
নেপাল
নেপালে সংখ্যালঘু জনগণের জন্য সরকারি চাকরিতে এবং শিক্ষায় কোটা ব্যবস্থা কার্যকর। এখানে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর উন্নয়ন এবং সমাজের ন্যায় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ব্যবস্থা রয়েছে।
ব্রাজিল
ব্রাজিলে শিক্ষা ও চাকরিতে বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠী এবং দরিদ্র জনগণের জন্য কোটা ব্যবস্থা রয়েছে। এটি আদিবাসী জনগণ ও আফ্রিকান বংশোদ্ভূত জনগণের জন্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য।
মালয়েশিয়া
মালয়েশিয়ার "Bumiputera" নীতি অনুযায়ী, মালয় জনগণের উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক সমতা নিশ্চিত করার জন্য সরকারি চাকরি ও শিক্ষা ব্যবস্থা কোটা ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ফিলিপাইন
ফিলিপাইনে, আদিবাসী জনগণের উন্নয়নের জন্য এবং তাদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কোটা ব্যবস্থা রয়েছে।
প্রত্যেকটি দেশের কোটা ব্যবস্থা সমাজের প্রয়োজন এবং বৈষম্য দূরীকরণের জন্য প্রয়োগ করা হয়, তবে এগুলোর কার্যকারিতা ও প্রভাব নিয়ে বিভিন্ন মতামত রয়েছে।
বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের আদিবাসীদের কোটা ব্যবস্থা
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আদিবাসী জনগণ এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর জন্য কোটা ব্যবস্থা বিভিন্নভাবে কার্যকর করা হয়ে থাকে। উদ্যোগগুলোর উদাহরণ স্বরূপ এখানে কিছু দেশের কোটা ব্যবস্থা তুলে ধরা হলো:
১. ভারত
ভারতে আদিবাসী জনগণের জন্য সরকারি চাকরি ও শিক্ষায় কোটা ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। “Scheduled Tribes” এবং “Scheduled Castes” নামে পরিচিত আদিবাসীদের জন্য এটি কার্যকরী।
২. কানাডা
কানাডার আদিবাসী জনগণের জন্য বিভিন্ন সরকারি কর্মসূচি ও চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা রয়েছে। আদিবাসীদের জন্য বিশেষ কর্মসংস্থান উদ্যোগ এবং শিক্ষা সহায়তার জন্য তহবিল প্রদান করা হয়।
৩. নেপাল
নেপালে আদিবাসী ও অন্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য সরকারি চাকরি এবং শিক্ষায় কোটা ব্যবস্থা চালু আছে। সরকার এই ধারার মাধ্যমে সমাজের অসমতা কমাতে চেষ্টা করছে।
৪. ব্রাজিল
ব্রাজিলে আদিবাসী জনগণ এবং আফ্রিকান উত্তরাধিকারীদের জন্য উচ্চ শিক্ষায় কোটা ব্যবস্থা রয়েছে, যাতে তারা সুবিধা পায় এবং শিক্ষায় আরও উন্নতি করতে পারে।
৫. অস্ট্রেলিয়া
অস্ট্রেলিয়ায় আদিবাসী জনগণের জন্য বিভিন্ন সরকারি পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থা আছে। এটি আদিবাসী জনগণের নিজস্ব সংস্কৃতি এবং সমাজের উন্নয়নে সাহায্য করে।
৬. মালয়েশিয়া
মালয়েশিয়ার "Bumiputera" নীতি অনুসারে মালয় জনগণের জন্য সরকারি চাকরি ও শিক্ষায় কোটা ব্যবস্থা রয়েছে, যা আদিবাসী জনগণের উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করে।
৭. ফিলিপাইন
ফিলিপাইনে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ কোটা ব্যবস্থা রয়েছে সরকারি চাকরি এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে। প্রক্রিয়াটি তাদের উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করে।
৮. পেরু
পেরুর আদিবাসী জনগণের জন্য নানান উপকারিতা ও কোটা ব্যবস্থা রয়েছে, বিশেষ করে সরকারি কর্মসূচিতে তাদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য।
এইসব কোটা ব্যবস্থা সাধারণত সরকারের নীতির অংশ হিসেবে কাজ করে এবং আদিবাসী জনগণের অধিকার ও সংহতি প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করে। তবে এসব ব্যবস্থার কার্যকারিতা ও সমালোচনাও রয়েছে, যা বিভিন্ন সমাজে আলোচিত হচ্ছে।
বাংলাদেশের বর্তমান কোটা ব্যবস্থা
২০২৩ সালে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের পরিমাণ কমানোর বিষয়টি আলোচনায় ছিল এবং কোটা সংক্রান্ত নীতিমালা নিয়ে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে বিতর্ক অব্যাহত ছিল। বিশেষ করে, পাশাপাশি মানে চাকরির প্রার্থীদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণে কার্যকর শূন্যপদের সংখ্যা কমে যায়।
বাংলাদেশের আদিবাসীদের কোটা ব্যবস্থা
বাংলাদেশের আদিবাসীদের নিয়ে কোটা ব্যবস্থা দেশের সরকারি চাকরিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী, আদিবাসী জনগণের বিশেষ অধিকার রয়েছে, এবং তারা সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া জনগণের অন্তর্ভুক্ত।
বাংলাদেশের সরকারি চাকরিতে আদিবাসীদের জন্য একটি নির্দিষ্ট কোটা ব্যবস্থা আছে। এই ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য হলো আদিবাসী জনগণের উন্নয়নকে নিশ্চিত করা এবং তাদের প্রতি বৈষম্য কমানো।
১। **চাকরির সুযোগ:** সরকারি চাকরিতে আদিবাসীদের জন্য একটি বিশেষ কোটা (বিভিন্ন সময় এতে পরিবর্তন আসতে পারে) আসলেই তাঁদের জন্য সুনির্দিষ্ট আসন সংখ্যা সংরক্ষণ করা হয়।
২। **শিক্ষায় সুযোগ:** শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি ও পদক প্রাপ্তির ক্ষেত্রে আদিবাসীদের জন্য কোটা থাকার মাধ্যমে তারা উচ্চশিক্ষার সুযোগ পান।
৩। **উন্নয়ন প্রকল্প:** সরকার বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে আদিবাসী জনগণের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে চেষ্টা করে।
এছাড়া, আদিবাসী জনগণের জন্য এই কোটা ব্যবস্থা কার্যকরভাবে কাজ করে কি না, সেই প্রশ্ন উঠতে পারে। বাস্তবে অনেক সময় তারা বিভিন্ন কারণে নিম্ন সদরে বা ভিন্ন সমস্যা মোকাবেলা করে। এই কারণে, কোটা ব্যবস্থা কার্যকরভাবে প্রয়োগের জন্য বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক উদ্যোগ প্রয়োজন।
বাংলাদেশে আদিবাসী জনগণের উন্নয়ন সিদ্ধান্ত গ্রহণে এবং বাস্তবায়নে নীতিমালা প্রণয়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।